(মুসলিমবিডি২৪ডটকম)
সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়সী রাহ.-এর জীবন ও কর্ম
কুতুবুল ইরশাদ, রসুলনোমা, হজরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়সী রাহ.।
জন্ম –
১৮২৫ সালে বাংলাদেশের চট্রগ্ৰাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের লোহাপাড়া থানার,ডাকঘর পদুয়ার মল্লিক সোবহানে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা মাতা-
ওয়সী হজরতের পিতা সৈয়দ ওয়ারেস আলী প্রথমে সৈয়দ হারিস আলীর নিকটে বাইআত হন।
কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদীয়া তরিকায় শিক্ষা হাসিল করেন। অতঃপর হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রায়বেরেলী রাহ.-এর নিকট মুরিদ হন।
চার তরিকার শিক্ষা হাসিল করে খিলাফতে ভূষিত হন। তাঁর কাব্য সাধনা,”আশকী”.। তিনি ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের কলেজের ফার্সির অধ্যাপক ছিলেন।
১৮৩১ সালের ৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধে পীর সৈয়দ আহমদ, ইসমাইল দেহলভী, তিনি সৈয়দ ওয়ারেস আলী শহীদ হন।
শহীদ কাকে বলে, শহীদ কত প্রকার ও কি কি এরহুকুম কি
একজন আরবি,ফার্সি,উর্দু ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন।ওয়সী হজরতের মাতা ছিলেন,চট্রগ্ৰামের সায়েদা বেগম আরবি, ফার্সি ,বাংলা ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
কুরআনে হাফেজা ও ক্বারি ছিলেন। তাঁর বংশধারা হজরত ফাতেমা বিনতে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
রাসূলের সা. প্রতি দোষারোপের জবাব
শিক্ষা –
তিনি শৈশবে অতিশয় মেধাবী,অত্যন্ত বুদ্ধিমান,আল্লাহপ্রেমিক ছিলেন।
১৮৩০ সাল পর্যন্ত তিনি পিতার কাছে কুরআন শরীফ, আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা শিক্ষা করেন।
তাঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল।সাত বছর বয়সে কুরআনে হাফেজ হন। শৈশব থেকেই তাঁর হস্তাক্ষর সুন্দর ছিল। কন্ঠস্বর ছিন অতি মধুর।
হাওড়া জেলার ধসার পারিবারিক পানাউল্লাহ মাদ্রাসায় কিছুদিন পিতার নিকট শিক্ষা হাসিল করেন।
এহেন সময় কুরআন, হাদীস, তাফসীর,ফিকাহ,উসুল,মানতেক,হিকমত কিতাব পাঠ করে গম্ভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
ছাত্র জীবনে ফার্সি কবিতা সমকালীন পত্রিকায় মুদ্রিত হতে থাকে।পরে হুগলি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (র.) [Maulana Jalauddin Rumi (R.)]( ১২০৭-১২৭৩)
ছাত্রজীবনে মুর্শিদাবাদের পুনাশির এমদাদুল হোসেন সাহেবের অনুরোধে তাঁর গৃহশিক্ষকের অংশকালীন চাকরি করেছেন।
চাকরি –
পিতার প্রতিষ্ঠিত সাতকানিয়া মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। অতঃপর কলকাতার তালতলায় গৃহশিক্ষতার কাজ করেন।
কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় অংশকালীন তিনি অধ্যাপক ছিলেন।
চাকরির অবসরে রাত্রিতে কুরআন পাঠ,নফল নামাজ,দরুদ পাঠ, ওজিফা ও মুরাকাবা মুশাহিদায় মশগুল থাকতেন।
হযরত খিজির আ. এর বর্তমান অবস্থা
চাকরির রত অবস্থায় হজরত খিজির আ.-এর সঙ্গে স্বপ্নে দর্শন হয়।
অতঃপর ১৮৫৬ সালে ওয়সী হজরত কলকাতা হাইকোর্টের অধীন কলকাতা নগর দায়রা আদালতে রেজিষ্ট্রেশন বিভাগে প্রধান রেজিষ্টার পদে চাকরিতে যোগ দেন।
১৮৬৭ সালে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ -এর অনুরোধে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব পদ অলংকৃত করেন।
১৮৬৮ সালে তিনি পলিটিক্যাল পেনশন অফিসের সুপার পদে চাকরিতে যোগ দেন।
এহেন সময় ওয়ালিউল্লাহ লেনে বিবি সালেটের মসজিদ সংলগ্ন কুঠিতে অবস্থান করতেন।
এই কুঠিতে আমার প্রপিতামহ গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরাবী রাহ.-এর যাতায়াত ছিল।
বিবাহ –
মুর্শিদাবাদের পুনাশি গ্ৰামের ইমদাদুল হোসেন সাহেবের দুই সন্তানের ওয়সী হজরত গৃহশিক্ষক ছিলেন।
তাঁর পিতৃব্য পুনাশির জমিদার খোন্দকার নেজাবত হোসেনের একান্ত অনুরোধে তাঁর নিকট আত্মীয়ের কন্যা মুসাম্মাৎ ফাতেমা খাতুনের সঙ্গে ওয়সী হজরতের বিবাহ সুসম্পন্ন হয়।
তিনি পুনাশিতে গৃহ নির্মাণ করার জন্য একটি জমি ক্রয় করলেন। উক্ত জমিতে একতলা বাড়ি নির্মাণ করা হয়।
পত্নীর প্রেরণায় তিনি একটি পুকুর,বাগান, কৃষিজমি ক্রয় করেন।
প্রায় নয় বিঘা কৃষিজাত জমিতে বনঔষধীর বাগান (ভুবন বাগান) প্রতিষ্ঠা করেন।
পত্নী ফাতেমা খাতুন অত্যন্ত নম্র ভদ্র রমনী ছিলেন। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
তিনি কখনো স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করতেন না। বছরের বেশি সময় রোজাব্রত পালন করতেন। প্রতিবেশীদের সর্বদা সাহায্য সহযোগিতা করতেন।
অনন্য মাধুর্য –
ওয়সী হজরত অপরূপ আরোগ্যজনক উজ্জ্বল নূরের আলোয় উদ্ভাসিত।গাত্রবর্ণ ছিল উজ্জল শ্যামবর্ণ,সুঠাম দেহ,মধ্যভাগে ভ্রুযুগল জোড়া ছিল।
বক্ষ ও উভয় স্কন্দ ছিল বিস্তৃত।চক্ষু ছিল সংযত ও নাসিকা মনোহর,ঘন দাড়ি।
চিবুক ছিল ঘন ভারমুক্ত শ্মশ্রু আবৃত। দাঁত ছিল মোতি -সুসজ্জিত, কঠিন সুন্দর ও দীপ্তিময়।সারা মস্তকে কেশে আবৃত।
পীড়িতদের সাক্ষাৎ ও সান্ত্বনা দিতেন। মৃত্যু সংবাদ জ্ঞাত হলে তাঁর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতেন।
ঈদ উৎসবে শিরওয়ানী, পাঁচ কলি গোল টুপি,নাগরা জুতা অপরিহার্য ছিল।
নসিহত —
(১) হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর মহব্বতে বিহ্বল হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা।
(২) যারা হজরত রাসূল সাঃ -এর দিদার আকাঙ্ক্ষা করে, তাঁরা যেন জীবনের আরাম,ভোগ বিলাস হারাম করে।
আধ্যাত্মিক গুরু –
হজরত পীর নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী হজরতের সমীপে সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়সী বাইআত হন।
দীর্ঘ সময় তাঁর খিদমতে আত্মনিবেদন করে বিলায়েত ও কামালিয়াত হাসিল করে খিলাফতে ভূষিত হন।
তিনি কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া -মুজাদ্দিদীয়া, আহমদীয়া তরিকায় বাইআত- এর এজাজত হাসিল করেন।
সন্তান-সন্ততি–
ওয়সী হজরতের দুই পুত্র ও দুই কন্যা ছিলেন।
(১)প্রথম পুত্র -সৈয়দ গোলাম মোস্তফা আলী রাহ.।
(২) দ্বিতীয় পুত্র -সৈয়দ আব্দুল্লাহ আলী -সাত বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
(৩)সৈয়েদা জোহুর খাতুন।
(৪) সৈয়েদা জোবেদা খাতুন ।
দিওয়ান -ই-ওয়সী-
প্রথম বাঙালি ফার্সি কবি ওয়সী হজরতের জীবনের শ্রেষ্ঠ সংকলন। হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর শানে ইশক ও মহব্বতের দৃষ্টান্ত স্বরুপ
১৭৯ টি গজল ও ২৩ টি কাসিদা লেখা ১৮৮২ সালে,১৩০০ হিজরিতে সমাপ্ত। ফার্সি ভাষায় গজল রচনায় হাফিজ,সাদি, ফিরদৌস-এর সমকক্ষ ছিলেন।
বিদগ্ধ মুরিদ ও খলিফা –
ওয়সী হজরতের জীবনের ৩৯ জন মুরিদ ও খলিফাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কয়েকজন –
(১) মাওঃ আব্দুল হক,সিজ গ্ৰাম, মুর্শিদাবাদ,(২) সুফি একরামুল হক, পুনাশি, মুর্শিদাবাদ,
(৩) সুফি আবুবকর সিদ্দিকী, ফুরফুরা শরীফ,
(৪) সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী, ফুরফুরা শরীফ,(৫)সৈয়দ ওয়াজেদ আলী,মেহদিবাগ,
কলকাতা (৬) সৈয়েদা জোহরা খাতুন,শাহপুর, মুর্শিদাবাদ
অন্তিম উপদেশ –
ওয়সী হজরত অন্তিম সময়ে উপদেশ দিলেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর কন্যা সৈয়েদা জোহরা খাতুন -এর কাছ থেকে
নিসবতে জামিয়ার ফায়েজ যেন তাঁরা হাসিল করেন। আমি আমার সর্বস্ব তাঁকে প্রদান করেছি।
গোলাম সালমানী আব্বাসী -কে তালাশ-
অতঃপর সুফি আবুবকর সিদ্দিকী ও সুফি আহমদ আলী সুরেশ্বরী রাহ.-কে গভীর রাতে জিজ্ঞেস করেন,
মাওঃ গোলাম সালমানী আব্বাসী কোথায়? কারণ, তাঁর সঙ্গে কিছু আলোচনা ছিল। তিনি তখন তথায় হাজির ছিলেন না।
প্রকাশ থাকে যে, ওয়সী হজরত তাঁর সিলসিলার কর্মধারা গোলাম সালমানী আব্বাসী -র হস্তে অর্পণ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
“জোহরা খাতুন -ও একই কথা বলেছেন। তাঁর নিকট নিসবতে জামিয়ার জন্য কেউ উপস্থিত হলে তিনি গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরাবী রাহ এর কাছে পাঠাতেন।
ইন্তেকাল-
হুগলি জেলার মোল্লাসিমলা হতে ট্রেনে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা পথে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনে সুফি আবুবকর সিদ্দিকী রাহ এর কোলে মাথা রেখে,
১৮৮৬ সালের ৬ ডিসেম্বর,১৩০৪ হিজরির ৮ রবিউল আউয়াল,১২৯৩ বঙ্গাব্দের ২০ অগ্ৰহায়ণ রবিবার বিকাল চার ঘটিকায় ইন্তেকাল করেন।(ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)
হাওড়া রেল স্টেশন থেকে পুলিশ পিকেট করে কলকাতা তালতলায় বিবি সালেটের মসজিদে দেহ মুবারক আনা হয়।
গোসল –
মসজিদ সংলগ্ন আবাসে গোসল কার্য সমাধা হয়ে গেল।
সালাতে জানাজা-
ক্রমানয়ে তিন দিন সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার সালাতে জানাজা পালিত হয়। এককভাবে কেউ ইমামত করেননি।
দাফন –
১৮৮৬ সালের ৯ ডিসেম্বর বুধবার দিবাগত রাতে কলকাতার মানিকতলা লালবাগান মহল্লার ২৪/১,
মুন্সিপাড়া লেনের দুই নম্বর দিল্লিওয়ালা কবরস্থানে ওয়সী হজরতকে কবরে দেহ শায়িত করা হয়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার -মুজাদ্দিদে আলফেসানী হয়ে সালমানিয়া সিলসিলা ।
লেখক -মুহাম্মদ নাসেরউদ্দিন আব্বাসী
প্রপৌত্র -হজরত সুফি পীর গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরাবী রাহ.