(মুসলিমবিডি২৪ডটকম)
بسم الله الرحمن الرحيم
খ্রিস্টাব্দের ২৯শে সেপ্টেম্বর বর্তমান আফগানিস্তানের বলখ নগরে জন্মগ্রহণ করেন এ মহামনীষী। তাঁর পিতার নাম ছিল বাহাউদ্দিন ওয়ালিদ।
পিতা ছিলেন তৎকালের স্বনামখ্যাত কবি ও দরবেশ। জানা যায় পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালিদের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি চতুর্দিকে
ছড়িয়ে পড়লে পারস্যের রুম প্রদেশের অন্তর্গত ‘কোনিয়া'র তৎকালীন শাসনকর্তা আলাউদ্দিন কায়কোবাদ মনীষী বাহাউদ্দিনকে কোনিয়ায় আমন্ত্রণ করে পাঠান।
আমন্ত্রণ পেয়ে বাহাউদ্দিন ওয়ালিদ সপরিবারে কোনিয়ায় চলে যান এবং রাজনৈতিক কারণে তিনি সেখানে বাসস্থান নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এ রুম প্রদেশের নাম অনুসারে তিনি ‘রুমী' নামে খ্যাতি লাভ করেন। ৫ বছর বয়স থেকেই মাওলানা রুমী রহমতুল্লাহি
আলাইহির মধ্যে বিভিন্ন অলৌকিক বিষয়াদি পরিলক্ষিত হতে থাকে। বাল্যকালে তিনি অন্যান্য ছেলেমেয়েদের ন্যায়
খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত থাকতে পছন্দ করতেন না। তিনি সর্বদা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আলোচনা পছন্দ করতেন।
৬ বছর বয়স থেকেই তিনি রোজা রাখতে শুরু করেন। ৭ বছর বয়সে তিনি সুমধুর কন্ঠে পবিত্র কুরআন বিশুদ্ধ ভাবে তেলাওয়াত করতেন।
কোরআন তেলাওয়াতের সময় তাঁর দুই নয়নে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতো। সম্ভবত এ বয়সেই তিনি কোরআনের মর্মবাণী ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদি অনুধাবন করতে পারতেন।
কথিত আছে মাওলানা রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহির বয়স যখন ছয় বছর তখন পিতা বাহাউদ্দিন রুমী রহমতুল্লাহি
আলাইহি কে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ইরানের নিশাপুরে যান এবং সেখানে বিখ্যাত দার্শনিক ফরিদউদ্দিন আত্তারের সাক্ষাৎ লাভ করেন।
শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার বালক জালালউদ্দিনের মুখচ্ছবি দেখেই তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে তার জন্য দোয়া
করেন এবং তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখার জন্য পিতাকে উপদেশ দেন। নিশাপুর ত্যাগ করে পিতা বাহাউদ্দিন রুমী
রহমতুল্লাহি আলাইহিকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ্ব সম্পাদন করেন এবং বাগদাদসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
পিতা নিজেই তাঁর পুত্রকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান সহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতে লাগলেন। শিক্ষালাভের প্রতি তাঁর ছিল পরম আগ্রহ।
১২৩১ সালে পিতার মৃত্যুর পর মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহঃ) মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাঁধা এসে দাঁড়ায়। মা তাকে হারিয়ে ছিলেন
আরো কয়েক বছর পূর্বে। এসময়ে কুনিয়া শহরে তিনি সাহচর্য লাভ করেন পিতার প্রধান শীর্ষ তৎকালীন পণ্ডিত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী সৈয়দ বোরহান উদ্দিনের।
সৈয়দ বোরহান উদ্দিন পিতৃকুল মাওলানা রুমীকে শিক্ষা দান করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য তিনি চলে যান প্রথমে সিরিয়া ও পরে দামেস্কে।
তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাত বছর অধ্যয়ন করেন। এছাড়া জ্ঞানের সন্ধানে তিনি 40 বছর বয়স পর্যন্ত ঘুরেবেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে ।
তিনি তাঁর শিক্ষা জীবনে তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীদের সাহচর্য লাভ করেন। তিনি যাদের থেকে জ্ঞান লাভ
করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুদ্দিন তাবরিজ (রহ.), ইবনে আল আরাবী (রহ.), সালাউদ্দিন ও হুসামুদ্দীন এর নাম উল্লেখযোগ্য।
রোমী (রহ.) এত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে, তৎকালীন সময়ে তাঁর সাথে অন্য কারো তুলনা ছিল না। কথিত আছে ১২৫৯ সালে চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খান যখন বাগদাদ
অধিকার করে তদীয় সেনাপতি কুতুব বেগকে দামেস্কের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন তখন দামেস্কবাসীদেরকে সহযোগিতা করার জন্যৈ ধ্যানযোগে তিনি দামেস্কে উপস্থিত হয়েছিলেন।
তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘মসনবী' ও ‘দেওয়ান' তাকে অমর করে রেখেছে। বাংলা ভাষাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তাঁর গ্রন্থ ‘মসনবী' অনূদিত হয়েছে।
আলেমগণ আজও বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় আলোচনাসভায় তাঁর রচিত কবিতা আবৃত্তি করে শ্রোতামন্ডলীকে আকৃষ্ট করে থাকেন।
পারস্যে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের পরই মসনবীকে যথার্থ পথপ্রদর্শক বলে মনে করা হয়। ‘দিওয়ানে' রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার শ্লোক, যারা সমস্ত আধ্যাত্মিক গজল।
তার সৃষ্ট সাহিত্য ও সংস্কৃতি অতুলনীয়।
রুমী (রহ.) ছিলেন মহাপন্ডিত। অসামান্য পাণ্ডিত্য তাঁকে দরবেশ বা সুফীতে পরিণত করেছে।
‘ই'লমে মা'রেফাত' ও ‘ইলমে লাদুনীতে' তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন। এটা হল শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের আলোয়।
সুফির মতে দেহই মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের মহা অন্তরায়। দেহের ভেতরে যে কামনা ও বাসনা মানুষকে সর্বদা সত্য পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়,
যা মানুষকে ব্যক্তিত্ব বা অহংকার প্রদান করে ভোগলিপ্সু করে, সে জৈব আকাঙ্ক্ষার নাম সুফিদের ভাষায় ‘নফস'।
নফসের ধ্বংসই দেহের কর্তৃত্বের অবসান ও আত্মার স্বাধীনতার পূর্ণতা। তাই নফসের বিরুদ্ধে সুফিদের আজীবন সংগ্রাম।
রুমী (রহ.) তাঁর সারাটা জীবন নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। রুমীর মতে বুদ্ধি, যুক্তি ও ভক্তি এক নয়।
বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আল্লাহকে চিনা, বুঝা ও পাওয়া যায় না। বরং এর জন্যে প্রয়োজন বিশ্বাস ও ভক্তি। ভক্তিই সোপান। আর ভক্তির উৎস হচ্ছে প্রেম ও আসক্তি।
রুমীর মতে আল্লাহ নির্গুণ নন। জ্ঞান, দয়া, করুণা, প্রেম ও ক্রোধ ইত্যাদি অসংখ্য গুণাবলী রয়েছে তাঁর।
কিন্তু মানুষ তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তির মাপকাঠি দিয়ে আল্লাহর গুণাবলী অনুধাবন করতে পারে না। কারণ, বুদ্ধি ও যুক্তি নিজেই একটি সৃষ্টবস্তু এবং মস্তিষ্ক ও স্নায়ুমন্ডলীর
সক্রিয়তার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং সৃষ্ট দিয়ে অসৃষ্টকে বুঝা সম্ভব নয়। আল্লাহকে বুঝতে চিনতে হলে ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রয়োজন।
তাহলেই অন্তর দিয়ে আল্লাহকে অনুধাবন করতে পারবে। মানুষ যখন মারেফাতের ঊর্ধ্বতন স্তরে উন্নীত হয় আপনার ভিতরে আল্লাহর প্রকাশ অনুভব করেন তখন তাঁর ব্যক্তিত্বের
সীমা কোথায় ভেসে যায়। তিনি তখন অসীমের ভেতর আপনাকে হারিয়ে ফেলেন। কিংবা তিনি নিজের সীমার ভিতর অসীমের সন্ধান লাভ করেন।
তখন তিনি আনন্দে বিভোর হয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রাজৈশ্বর্যকে একেবারেই তুচ্ছ বোধ করেন। মারেফাতের স্তর উন্নত হলে আত্মা ও পরমাত্মা মধ্যে আর কোন ভেদাভেদ থাকে না।
এ অবস্থার নাম হলো ‘হাল'। এ কথাগুলো পৃথিবীর মানুষের সামনে পেশ করে গেছেন মাওলানা রুমী (রহ.)। ইহজগতে থেকে মানবাকৃতি বজায় রেখে মানুষ কিভাবে অস্তিত্বহীন
হতে পারে তা মাওলানা রুমী দেখিয়েছেন।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) ‘ভাগ্য পুরস্কার' সমস্যার সহজ সমাধান দিয়েছেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের সকল কার্যের নিয়ন্তা আল্লাহ। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, আল্লাহপাক মানুষকে কতগুলো কার্যের পূর্ণ স্বাধীনতা বা স্বেচ্চাধিক্কার
দিয়েছেন, যার সীমারেখার মধ্যে মানুষ নিজেই তার কর্মপন্থা নির্বাচনের অধিকারী। এসকল কার্যাদির কর্মফলের জন্যে মানুষ নিজেই দায়ী।
কারণ, এগুলো করা না করা তারই স্বেচ্ছাধিকারভুক্ত, যদিও কর্ম করার শক্তি আল্লাহই মানুষকে প্রদান করেছেন।
রুমী (রহ.) ছিলেন তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী।
রুমী (রহ.) খুবই সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। তিনি যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন সে তুলনায় দুনিয়া তুচ্ছ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
মৃত্যুকালে তাঁর কোন সঞ্চিত ধন-সম্পদ ছিল না।
৬৬ বছর বয়সে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
তাঁর অসুস্থতার সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে চতুর্দিক হতে হাজার হাজার লোক গভীর উদ্বেগের সাথে ছুটে আসে।
বিখ্যাত চিকিৎসক শেখ সদরুদ্দিন, আকমাল উদ্দিন ও গজনফার তাঁর চিকিৎসা করে ব্যর্থ হন। এসময় রুমী (রহ.) চিকিৎসক শেখ সদরুদ্দিন সাহেবকে লক্ষ্য করে বললেন, “
আশেক ও মা'শুকের মধ্যে একটিমাত্র পর্দার ব্যবধান রয়েছে। আশেক চাচ্ছে তার মাশুকের কাছে চলে যেতে।
পর্দাটা যেন দ্রুত উঠে যায়।” শেখ সদরুদ্দিন বুঝতে পেরেছিলেন, রুমী (রহ.) এর আয়ু শেষ হয়ে আসছে।
অর্থাৎ রুমী (রহ.) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার জন্যে তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরপর তিনি তাঁর শিষ্যদের সান্ত্বনা দিয়ে কিছু উপদেশ দিলেন, যার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা
হলোঃ
ইন্দ্রিয়লালসাকে কখনো প্রশ্রয় দেবে না। পাপকে সর্বদা পরিহার করবে। নামাজ ও রোজা কখনো কাজা করবে না। অন্তরে ও বাহিরে সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলবে।
বিপদে ধৈর্য ধারণ করবে। বিদ্রোহ ও প্রতিশোধমূলক মনোভাব পোষণ করবে না। নিদ্রা ও কথাবার্তায় সাধ্যানুযায়ী সংযমী হবে। কাউকে কোন প্রকার কষ্ট দেবে না ।
সবসময় সৎ লোকদের সংস্পর্শে থাকবে। মনে রাখবে, মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ, যার দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত হয়।
তারপর তিনি বলেন, মানুষের দেহ নশ্বর কিন্তু তার আত্মা অবিনশ্বর। এ নশ্বর দেহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বটে,
কিন্তু তার ভেতর যে অবিনশ্বর আত্মা রয়েছে তা চিরকালই বেঁচে থাকে।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রহঃ) ৬৬ বছর বয়সে ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন।