যারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে, তাদের প্রতিদান আল্লাহর কাছে রক্ষিত থাকবে।
তাদের ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না।
(সূরা বাকারা- ৬২)
হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা মহানবীর দরবারে উপস্থিত ছিলাম।
হঠাৎ আমাদের নিকট এমন এক ব্যক্তি আবির্ভূত হলেন, যার পরিচ্ছদ ছিল সাদা ধবধবে আর চুলগুলো ছিল কাল মিচমিচে।
সফরের কোন চিহ্নই তার শরীরে ছিল না, অথচ আমাদের মধ্যে কেউ তাকে চিনতেও পারলনা।
অত:পর তিনি হুজুরের কাছে এসে এমনভাবে বসলেন যে, তার জানুদ্বয় ছিল হুজুরের জানুদ্বয়ের দিকে, আর তার হস্তদ্বয় ছিল তার উরুদ্বয়ের উপর।
অত:পর তিনি বললেন, হে মুহাম্মদ! (সা:) আপনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বাতলিয়ে দিন।
হুজুর (সা:) বললেন, ইসলাম হলো তুমি আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা:) তার রাসূল এ কথার সাক্ষ্য দিবে।
অত:পর নামাজ কায়েম করবে, যাকাত দিবে, রমজান মাসের রোজা রাখবে এবং সামর্থ থাকলে বায়তুল্লাহর হজ্জ করবে।
লোকটি বললেন, হা আপনি ঠিক বলেছেন। তার এ ধরণের প্রশ্নোত্তরে আমরা আশ্চর্য হলাম। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন যে, আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলে দিন।
হুজুর (সা:) উত্তর দিলেন, ঈমান হলো এই যে, তুমি আল্লাহ, তার ফিরিশতা, কিতাব, পয়গম্বর ও পরকালের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে।
আর তাকদীরের ভালমন্দের উপরেও ঈমান আনবে। লোকটি বললেন, হা আপনি ঠিকই বলেছেন।
প্রিয় পাঠক লক্ষ করুন
অত:পর তিনি বললেন, আমাকে ইহসান সম্পর্কেও বলে দিন। হুজুর (সা:) বললেন, ইহসান হলো তুমি এই মনে করে আল্লাহর ইবাদত করবে,
যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ। আর তুমি যদি তাকে নাও দেখতে পাও তাহলে মনে করবে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন।
আগন্তুক বললেন, এবার তাহলে আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে বলে দিন। হুজুর জওয়াব দিলেন, “কিয়ামতের (দিন-তারিখ) সম্পর্কে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে।
তিনি প্রশ্নকারীর অপেক্ষা অধিক কিছু জানেন না। লোকটি বললেন, তাহলে আমাকে তার নিদর্শনগুলো বলে দিন।
হুজুর (সা:) বললেন, দাসীরা তাদের প্রভুকে জন্ম দিবে,
আর তুমি দেখতে পাবে (এক কালের) পাদুকাহীন, বস্ত্রহীন, লম্বা ঘাড়ওয়ালা রাখালেরা দালান-কোঠার অভ্যন্তরে স্বগর্বে বসবাস করছে।
হযরত উমর (রা:) বললেন:-
অত:পর লোকটি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ অবস্থানের পর হুজুর (সা:) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, উমর! প্রশ্নকারী লোকটিকে চিনতে পারলে?
আমি বললাম আল্লাহ এবং তার রাসূলই জানেন। (আমি জানিনা) হুজুর বললেন, ইনি হলেন হযরত জিবরীল (আ:)।
তোমাদেরকে (প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে) দ্বীন তালীম দেয়ার জন্য এসেছিলেন।
(মুসলিম শরীফ)
(ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া ইমাম বুখারীও সামান্য রদ-বদলসহ তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থে উক্ত হাদীসটি লিপিবদ্ধ করেছেন।
ব্যাখ্যা:
প্রশ্নকারী হযরত জিবরীল (আ:) ছিলেন বলে হাদীসটিকে “হাদীসে জিবরীল ” বলা হয়।
হাদীসটিতে দ্বীন সম্পর্কীয় তিনটি মৌলিক বিষয় (ইসলাম, ঈমান, ও ইহসান) ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে।
ইসলাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো আত্নসমর্পণ করা, অনুগত্য করা, নিজেকে সুপে দেয়া।
আর শরীয়তের পরিভাষায় ইসলাম হলো আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুগত্য করা এবং আল্লাহর দ্বীনের কাছে নিজেকে পুরোপুরি সুপে দেয়া।
ইসলামের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হুজুর (সা:) যে পাচটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন তা হলো ইসলামের পাচটি মৌলিক অঙ্গ বা বুনিয়াদ।
ফলত: কালেমার ঘোষ্ণাসহ হাদীসে বর্ণিত পাচটি বিষয় যার ভিতরে পাওয়া যাবে মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র অবশ্যই তাকে মুসলমান হিসেবে স্বীকার করে নিবে।
আর মুসলমানের যাবতীয় অধিকার তাকে দিতে বাধ্য থাকবে।
ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো নিগূঢ় -বিশ্বাস, দৃঢ় প্রত্যয়, গভীর আস্থা। আর পারিভাষিক অর্থ হলো আল্লাহ তার রাসূলের মাধ্যমে মানব জাতির নিকট,
যে দ্বীন পেশ করেছন, তাকে মনে-প্রাণে মেনে নেয়া এবং তার সত্যতার উপর গভীর আস্থা স্থাপন করা।
প্রিয় পাঠক বিষয়টি ভালভাবে খেয়াল করে পড়ুন।
যে ছয়টি বিষয়ের প্রতি ঈমান না আনলে মানুষেকে প্রাথমিক ইমানদার রূপেও গণ্য করা হয় না, হাদীসে সেই ছয়টি মৌলিক বিষয়ের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান। আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ হলো আল্লাহকেই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা।
বিধান দাতা, রিযিক দাতা, পালনকর্তা এবং সমগ্র বিশ্বের প্রকৃত মালিক বপে আন্তরিকভাবে স্বীকার করে নেয়া।
আর এসব ব্যাপারে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক বা অংশীদার না করা।
ঈমানের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার উপরোক্ত গুণাবলী একক ও অভিভাজ্য।
যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর সৃষ্টিকর্তা হওয়াকে অন্তরের সাথে বিশ্বাস করে, কিন্তু তার বিধানদাতা হওয়ায় সন্দেহপোষণ করে।
অর্থাৎ আল্লাহর বিধান যে জীবনের সব ক্ষেত্রে মেনে চলতে হবে তা সে স্বীকার করে না, তাহলে সে মুমিন নয়।
দ্বিতীয় হলো ফিরিশতাদের প্রতি ঈমান। ফিরিশতাদের প্রতি ঈমানের অর্থ হলো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে যে, ফিরিশতাগণ হলো আল্লাহর মহান সৃষ্টিকুলের একটি জীব।
আল্লাহ তায়ালা এদেরকে নূর দিয়ে তৈরি করেছন। এরা পুরুষও নন,স্ত্রীও নন। প্রয়োজনবোধে ফিরিশতারা নানা ধরণের রূপ ধারণ করতে পারেন।
আল্লাহ সৃষ্টি পরিচালনায় যাবতীয় কাজে এদের নিয়োগ করে রেখেছেন। এরা কখনও আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না।
তৃতীয় হলো কিতাবের প্রতি ঈমান। অর্থাৎ আল্লাহ যুগে যুগে মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য পয়গাম্বরদের উপর যে কিতাব নাজিল করেছন।
তা সঠিক, সত্য ও নির্ভুল বলে আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করা।
আল্লাহ তায়ালার নাজিল করা অসংখ্য কিতাবের মধ্যে চারখানা হলো প্রধান। যথা: তাওরাত, যবুর,ইঞ্জিল, ফোরকান।
ফোরকান বা কোরআন হলো আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ গ্রন্থ। কোরআনের ভিতরে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের যাবতীয় সত্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির হেদায়েতের যাবতীয় বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
অত:পর আর কোন আসমানী কিতাব নাজিল হবে না। অতএব কোরআন পরবর্তী যুগে কারও পক্ষে কোরআন কে অনুসরণ ব্যতীত পরকালের মুক্তি সম্ভব নয়।
মানব জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিষয় সম্পর্কে কোরআনে যেসব নির্দেশ দান করা হয়েছে তার সবটকুকেই অবশ্য করণীয় মনে করতে হবে।
অন্যথায় কেউ মুমিন হতে পারবে না।
ঈমানদার হওয়ার জন্য চতুর্থ যে বিষয়টির উপর বিশ্বাস স্থাপন করা একান্ত অপরিহার্য, তা হলো ররাসূলেদের প্রতি ঈমান।
রাসূল শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো প্রেরিত। আর শরীয়তের পরিভাষায় রাসূল বলা হয় তাদেরকে,
যাদেরকে মহান আল্লাহ যুগে যুগে জগতের বিভিন্ন অংশে মানব জাতির হেদায়েতের নিমিত্ত অহী ও কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছেন।
মানব দুনিয়ায় অসংখ্য নবী রাসূলের আবির্ভাব ঘটেছে। তন্মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা:) হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল।
রাসূলদের প্রতি ঈমানের অর্থ এই যে, আল্লাহর প্রেরিত সকল নবী রাসূলদের প্রতি এই মর্মে ঈমান আনতে হবে যে, তারা,সকলেই ছিলেন মাসুম এবং আপন আপন যুগের সবচেয়ে জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি।
আর যে হেদায়েত তারা বহন করে এনেছিলেন তা ছিল নির্ভুল ও আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত।
সমগ্র পয়গাম্বরদের ভিতরে হযরত মুহাম্মদ (সা:) যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ, তেমনি তিনি সর্বশেষ পয়গাম্বরও।
পূর্ববর্তী পয়গাম্বরগ্ণ বিশেষ কোন গোত্রের যুগের কিংবা এলাকার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন।
কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা:) প্রেরিত হয়েছিলেন সারা বিশ্বের সমগ্র মানব মণ্ডলী উদ্দেশ্যে।
যেমন আল্লাহ কোরআনে বলেন:
“হে রাসূল, অবশ্যই আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির পয়গম্বর করে পাঠিয়েছি।”
(সূরা সাবা-৭৮)
পঞ্চম হলো পরকালের প্রতি ঈমান। অর্থাৎ অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, মৃত্যুর ভিতর দিয়ে জীবনের সমাপ্তি ঘটেনা বরং জীবনের অন্য একটি স্তরে প্রবেশ করে,
যার নাম পরকাল। এই পরকালেরই এক পর্যায়ে পার্থিব জীবনের যাবতীয় কাজের হিসাবান্তে মানুষকে তার ফলাফল প্রদান করা হবে।
ফলে কেউ বেহেশতী হবে, আবার কেউ হবে দোযখী।
হাদীসে উল্লেখিত সায়াত শব্দ দ্বারা উক্ত বিচারের দিনটি বুঝানো হয়েছে।এ দিনটিকে হাশর বা কিয়ামতের দিনও বলা হয়।