Breaking News
Home / ইসলাম ধর্ম / হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী(র.)ঃহাতিম আল-ফেরদৌসী

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী(র.)ঃহাতিম আল-ফেরদৌসী

(মুসলিমবিডি২৪ডটকম)

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালীঃ হাতিম আল-ফেরদৌসী

 بسم الله الرحمن الرحيم

হিজরী চতুর্থ শতকের বিদায়লগ্নে মুসলিম জাহানের ভাগ্যাকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মুসলিম সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ গোলযোগই এর দায়ী।

খুলাফায়ে রাশিদীনের শেষ যামানায় ইসলামে হলো ভ্রান্ত দলের আবির্ভাব। হযরত মুহাম্মাদ (স.)-র সঠিক আদর্শে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম জাতীর বিশ্বাস ও আদর্শসৌধের বিপক্ষে

ইসলামে ভ্রান্ত দলগুলো দাঁড় করলো নতুন মতবাদের কালো পাহাড়। এবার প্রত্যেকে নিজেদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে ঝাপিয়ে পড়ে ভয়াবহ বিতর্ক-যুদ্ধে।

এ বিতর্কের মূল উপকরণ ছিলো আল্লাহর সত্তা, তাঁর গুণাবলী, শরীয়তের আদেশ-নিষেধ, তাকদীর, তাওহীদ। তাছাড়া, মানব জীবন পরিচালনায় যেসব  বিষয়ের উপর

পবিত্র কোরআন তেমন একটা গুরুত্তারোপ করেনি বা যে সম্পর্কে নীরব ভূমিকা পালন করেছে কিংবা যে ভাবের প্রতি মোটামুটি ইঙ্গিত করাকেই যথেষ্ট মনে করেছে যেমন:

আসমান-জমিন আবর্তন, ওহীর স্বরূপ, ফেরেশতার মাহাত্ম্য ইত্যাদিও তখন পরিণত হয়েছিল বিতর্ক যুদ্ধের বিরাট কেন্দ্রে।

এ বিতর্কে বাতিল দলগুলো নিজেদের মতবাদকে জিতিয়ে রাখতে প্রথম প্রথম যদিও পবিত্র কোরআন ও ের পাশাপাশি যুক্তিকে গ্রহণ করেছিলো কিন্তু ক্রমেই তারা

কোরআন-হাদিসকে পরিত্যাগ করে দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে কেবলই দাবিত হচ্ছিলো যুক্তির দিকে। অতঃপর আরব বিশ্বে  আলকিন্দির(৮০১-৮৭০) হাতে গ্রিক দর্শনের

পুনর্জন্ম হলে ইসলামী ভ্রান্ত মতবাদগুলো বিতর্কের নতুন পদ্ধতি হিসেবে পবিত্র কোরআন ও হাদীসে (স.)-র স্থলে গ্রীক দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাকে দলীল-প্রমাণসরূপ গ্রহণ

করে মুখবাজীর চরম লড়াই প্রদর্শন করতে শুরু করে। অথচ, গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্ম হয় শিরক ও মুর্তি পুজার উদরে।

তার ক্রমোন্নতি ঘটে খ্রীস্টান, ইহুদী এবং দু'খুদাবাদী অগ্নিপুজকদের কোলে। আর তার কর্মফল গড়ায় নাস্তিক্যবাদের সীমায়।

এখন যেহেতু গ্রীক দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাকে বিপক্ষের মুকাবেলায় হাতিয়ার রূপে গ্রহন করা হচ্ছে এতে গ্রিক দর্শন হয়ে ওঠেছে বিশেষ গুরুত্তের অধিকারী।

চর্চিত হতে থাকে গ্রিক দর্শন ব্যাপক চর্চায়। ফলে সময়ের সাথে সাথে তা হিজরী চতুর্থ শতকের শেষ দিকে জৌওয়ানিতে পৌঁছে যায়।

গ্রিক দর্শনের ডঙ্কা বেঝে ওঠে চারদিকে।ঐ দর্শনের বিরুদ্ধে কিছু বলা ছিলো তা। পরিস্তিতি এতদূর গড়ায় যে, ধর্মীয় বিশ্বাসের যথার্থতার সব চাইতে বড় তুলাদন্ড যা ছিলো তা

হলো __ দর্শন নীতিতে তা কতখানি উত্তীর্ণ।বিশেষতঃ বাতিনিয়া মতবাদ ছিলো তখন রাজনীতি ও শরীয়ত মিশ্রিত বিক্রিত এক ধর্মীয় রূপ।

ইসমাঈলী শী'আদেরকে মূলত বাতিনিয়্যাহ বলে অভিহিত করা হতো। কারণ, তারা কোরআন ও হাদীসের জাহেরী বা প্রকাশ্য অর্থের নিগূঢ়ে মনগড়া এক বাতেনী বা গোপন অর্থের

দাবীদার। আর সেই মনগড়া বাতেনী অর্থের উপরই কেবল তারা  গুরুত্ত্বারুপ করতো। ৪৬৪/১০৭১-৭২সনের এই সময়ে দুর্ত ধুকাবাজ হাসান ইবনে সাব্বাহ ছিলো এই

বাতিনিয়্যাহদের নেতা। সে মূলত সালজুক রাজ্যের প্রধান ইসমাঈলী দাঈ “আব্দুল মালিক ইবনে আততাশে”র একজন প্রতিনিধি। একজন ইসমাঈলী শী'আয়ী ” আলী ইবনে আস-

সাব্বাহ আল-হিময়ারী”র কোলে হাসানের জন্ম। অধ্যয়নকালেই ১৭ বছর বয়সে সে ইসমায়্ঈলী মতবাদে দিক্ষিত হয়।হাসান ইবনে সাব্বার কর্মতৎপরতায়

বাতিনিয়্যাহগণ হয়ে ওঠে আরো শক্তিশালী। বাতিনিয়্যাহদের চরিত্র প্রধাণত রাজনৈতিক। দর্শণের বক্ষপটে ছিলো তাদের জন্ম।

তারা দার্শনিক বিষয়াদিকে ধর্মীয় বিষয়রূপে অভিহিত করে দের বিপথগামী করার চেষ্টা চালায়। এসময় তাদের প্রচার ও প্রসার ছিলো তুঙ্গে।

একদিকে ছিলো গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহুল চর্চা, অন্যদিকে ঘরে ঘরে বাতিনিয়া সাহিত্যের ছড়াছড়ি। ফলে মুসলিম ধর্মীয় মহলে সন্দেহ ও সংশয়ের ঝড় বইছিলো।

ইতিপূর্বে হকপন্থী ধর্মীয় বেত্তাগণ যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। কাজেই দর্শন বিষয়টি প্রথম থেকেই তাদের পাঠ্যতালিকাভুক্ত না থকায় দর্শন ও

যুক্তিবিদ্যায় তাঁরাছিলেন সংকির্ণ জ্ঞানী। ফলে যুগের এ সংকট নিরসনে উলামা, মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কেরাম হলেন অপারগ।

যুগের মুতাকাল্লিমগণ দর্শনের সুক্ষ বিচারে তেমন একটা সক্ষম ছিলেন না। এজন্য এদের অনেকে এরূপ নতুন চিন্তাধারার সাথে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে ছিলেন অপ্রস্তুত।

বাতিলরা এ সুযুগকে গ্রহণ করলো প্রফুল্লতারসাথে। তারা পবিত্র কোরআন-হাদীসের দলীলকে আপামর জনতার সামনে যুক্তির চালবাজিতে ভুল প্রমাণিত করে তাদের

ঈমানকে ভেস্তে দিচ্ছিলো। মুসলিম উম্মার এহেন দুর্দিনে ইসলামের আকাশে প্রয়োজন ছিলো এমন এক সূর্যের যা তাবৎ কালিমাকে ম্লান করে আপন শক্তিতে দীপ্তমান হয়ে ওঠে।

আল্লাহপাকের অপার মহিমায় সে সূর্য উদয় হলো আবুহামীদ গাযালী ধারণ করে। ইমাম গাযালী ওহীভিত্তিক ও বুদ্ধিভিত্তিক এ উভয় প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন।

গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মর্ম আর রহস্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন পূর্ণ অভিজ্ঞ। যে সব পদ্ধতি ও হাতিয়ার অবলম্বনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি হচ্ছিলো সে বিষয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দী পক্ষের চাইতেও

বেশী জ্ঞান রাখতেন। কাজেই তিনি দর্শন ও বাতিনিয়াবাদের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি নিয়োজিত করতে সক্ষম হন। এক দিকে তিনি গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীব্র সমালোচনা করেন

অন্যদিকে বাতিনিয়া মতবাদের অশুভ উদ্দেশ্যগুলো এক এক করে ফাঁস করে দেন। অতঃপর তাঁর মতে দার্শনিকদের যেসব বিষয় বিশুদ্ধ বলে মনে হয়েছিলো, ইসলামের

নীতিমালার সাথে সে গুলোর সামঞ্জস্য বিধান করেন। সেইসাথে বাতিল যে পথ ধরে আক্রমণ করছে সে পথেই তাকে বিতাড়িত করতে তিনি হক্ব পন্থী মুসলমানদের মধ্যে

আওয়াজ দিলেন __দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা অর্জন করা ফরযে কিফায়া। দর্শন সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বললেন__”গুটি কতক বিষয় ব্যতীত এতে ধর্মীয় বিরোধী

কিছুই নেই। ইমাম সাহেবের চেষ্টার ফলে দর্শন ধর্মীয় মহলে প্রসার লাভ করে এবং দর্শনও ধর্ম র পাশাপাশি এগোতে শুরু করে। তাঁর এ আহ্বানের ফলেই ইমাম রাযী,

শাইখুল ইশরাক, আল্লামা মাহমুদী ও মুহাম্মদ বিন আব্দুল করীম শাহরিস্তানীর মতো ইলমে কালামবিদের আবির্ভাব ঘটে। যাঁরা ছিলেন বুদ্ধি ও ওহীভিত্তিক জ্ঞানের শিরোমণি।

ইমাম গাযালী যে পরিবেশে লালিত পালিত ও শিক্ষা প্রাপ্ত হন, তাতে দর্শনের চর্চা ছিলো অত্যদিক। বুদ্ধিজাত জ্ঞানের কদর ছিলো সর্বাদিক।

তাই ইমাম গাযালী যুগের চাহিদাকে সামনে রেখে জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় কাটতে শুরু করেন অক্লান্ত সাঁতার। ফলে তিনি হয়ে গেলেন একাধারে ফিকহবিদ, তাফসীর কারক,

মুসলীম যুক্তিতত্ত্ব বিশারদ,দার্শনিক, সূফী, মরমী সাধক,সমালোচক, নীতিজ্ঞ,হিতোপদেশক এবং সর্বোপরি ধর্মীয় সংস্কারক।

তবে তাঁর প্রতিভার সর্বাধিক স্ফুরণ ঘটে “হেতুবাদ ও কর্মফল”দর্শনে। তিনি ছিলেন যুগের সর্বসেরা মুসলিম চিন্তানায়ক; স্বাধীন প্রেরণা ও চেতনার নকীব।

অন্ধ অনুকরণে তিনি কখনো বিশ্বাসী ছিলেন না। ওহীবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যে তিনি এমন ভাবে সামঞ্জস্য স্থাপন করেন যে, কোনটিরই অস্তিত্ব অক্ষুন্ন হয়নি।

গ্রীক দর্শনের প্রতি ইমাম সাহেবের না ছিলো বিদ্বেষ আর না আসক্তি। কিন্তু গ্রীক দর্শনের প্রতি তৎকালীন লোকের অতিমাত্রায় ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকায় তিনি এর সমালোচনায়

অবতীর্ণ হন এবং দর্শনের যেসব বিষয় আংশিক বা পুরোপুরী ইসলাম বিরোধী ছিলো, সেগুলোর বিরোধিতা করে “তুহফাতুল ফালাসিফা” (দর্শনের অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তা)

নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া তিনি ইসলামের সাথে সম্পর্ক নেই, এমন কিছু গ্রীক দর্শনেরও অসারতা প্রমান করেন। এমনি করে তিনি মুসলিম সমাজে গ্রীক

দর্শনের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ হ্রাস করেন। মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্ব প্রথম দর্শনভ্রম সংশোধনে ব্রতী হন।

জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইমাম সাহেবের রচনা রয়েছে এবং প্রত্যেকটি রচনায় তাঁর একটা নতুন রূপ ও নতুন দিক ফুটে উঠেছে। তাঁর কতেক গ্রন্থ মুসলিম সমাজের সর্বস্বাধারণের

জন্য রচিত আর কতেক রচনা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল জ্ঞানী ও বিশেষ মহলের জন্য।

এ দ্বিতীয় প্রকারের গ্রন্থগুলোতে তাঁর গূড় তাত্ত্বিক মতবাদও মতামত বিধৃত হয়েছে।

ইমাম গাজালীর গ্রন্থাবলী ধর্ম ও দর্শনজ্ঞানরাজ্যে বৈপ্লবীক জোওয়ার জাগায়। তাঁর এ বিপ্লবের সামনে তাবৎ বাতিল দল নিস্তব্ধতার আড়ালে আত্মগোপন করে।

দর্শনের উপর তাঁর বিভিন্ন লেখনীর সামনে থেমে যায় গ্রীক দর্শনের জয়ঢঙ্কা। শুধু এখানেই শেষ নয়; ইমাম গাযালী দর্শন বিশ্ললষণে যে জ্ঞানগর্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত এবং বিভিন্ন শাখায়

সতন্ত্র আবিষ্কারের অপরূপ ঝলক দেখিয়েছেন এতে পশ্চিমা দার্শনিকগণ অবাক না হয়ে পারেননি। ইমাম গাযালীর জ্ঞানরাজ্যের সামনে তারা নিজেদেরকে অজান্তেই নগন্য মনে

করতে শুরু করলো। তাঁর রচনাবলীর মাহাত্য তাদের কাছে বড় হয়ে ধরা পড়লো। দর্শন ও নীতিশাস্ত্র এবং বুদ্ধি ও ওহীর মধ্যে সমন্বয় সাধনে ইমাম গাযালী যে সব গ্রন্থ রচনা করেন

ইউরোপে সেগুলোর কেবল অনুবাদই হয়নি বরং খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে সে গুলোর মুদ্রণের কাজও শুরু হয়ে যায়।

ইউরোপীয় মনীষীদের মধ্যে ইমাম গাযালীর চিন্তাধারা বেশ প্রসার লাভ করে। তাঁরা সেগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং নিজ ভাষায় এমনভাবে রূপান্তরিত করেন যে,

অনেকে ঐসব বিষয় ইউরোপীয়দের চিন্তাধারা বলেই মনে করতে আরম্ব করেন। ১৯২৮ সালের জুলাই মাসে আল কুদসের জনৈক লেখক “আল-মুকতাফ”

পত্রিকায় ইউরোপীয় দার্শনিকদের এমন কতগুলো বিষয় সন্নিবিষ্ট করেন, যেগুলো ছিলো ইমাম গাযালীর রচনাবলী থেকেই সংগৃহীত। ইমাম গাযালীর পরবর্তী দার্শনিক

যেমন _ পাসকাল, ডেকার্ট, হিউম, কান্ট, ডক্টর ইকবাল, রেনান, প্রফেসর ঘোষ, ম্যাককোনালড, নেহরী লুইস, ফ্লুগেল, সেন্ট অগাস্টিন, ডক্টর টি, জে. ডি. বোয়ার, ইবনে বাজ্জাহ,

ইবনে তোফায়েল, ইবনে রুশদ প্রমুখ ইমাম গাযালীকে পাঠ না করে এগোতে পারেননি।

তখনকার সময়ে যেহেতু ইসলামের চতুর্মুখী শত্রুর মুখাবিলায় ইমাম গাযালী ছিলেন এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর যার সামনে বাতিলের মাথা নুয়ে পড়ে একেবারে, তাঁর মুখ নিঃস্রিত কথার

বিপরীতে সকল অপশক্তি ছিলো লা-জওয়াব, তাই তাকে হুজ্জাতুল ইসলাম বা ইসলামের দলীল উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইমাম গাযালীর স্থান যেরূপ অতুলনীয়, ঠিক সূফীসাধনায়ও তার অসাধারণ অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন একজন মহান সূফী।

এ বৈশিষ্টের দরুণ তিনি আজ মুসলিম বিশ্বে অমর। ধর্মীয় মহলে অন্যান্য দিকের তুলনায় সূফী-সাধক রূপেই তাঁর বেশী কদর; বেশী জনপ্রিয়তা।

ইতোপূর্বে সূফীবাদ স্বতন্ত্র একটি বিষয়রূপে গণ্য করা হতো না। ইমাম সাহেব এ বিষয়ে এতো বেশী মূল্যবান রচনা-সম্ভার রেখে গেছেন যা আজো কেউ ছাড়িয়ে যেতে  পারেনি।

তাঁর সূফী-সাধনার ফলে একটি সমৃদ্ধ বিষয়ে পরিণত হয়। ইমাম সাহেবের পূর্বে সূফীদের অনেকে ধর্মবহির্ভুত কাজে লিপ্ত দেখা যেত।

খুদাপ্রেমের দোহাই দিয়ে অনেক সময় নামায, রুযাও তারা লঙ্ঘন করত। তাই সূফীদের প্রতি শরীয়ত পন্থী জনগনের তেমন একটি ভক্তি ছিলো না।

ইমাম সাহেব শরীয়তের সঙ্গে তাসাউফের সমন্বয় সাধন করেন এবং সূফী-সাধনার জন্য শরিয়তের আদেশ-নিষেধ পালন করা আবশ্যকীয় কর্তব্য বলে লেখনী চালনা করেন।

ফলে তাসাউফের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব বিদূরীত হয় এবং তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইমাম সাহেবের সূফীবাদ কর্ম বিমুখ সূফীবাদ ছিলো না।

সংসারী হয়েও মানুষ কি করে মরমিয়া পথ অবলম্বন করতে পারে তার শিক্ষা ইমাম গাজালির সূফীবাদে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এ ভাবে ইমাম গাযালী ইসলামে প্রবিষ্ট বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করে সংস্কার সাধন করায় তাকে “যাইনুদ্দীন বা ইসলামের সৌন্দর্য উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

জন্ম ও শৈশব:

ইমাম গাযালী সেলজুকি শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ও বাগদাদ বিজয়ী তুগরিল বেগের সময়ে খোরাসানে অবস্থিত তূস জেলার অন্তর্গত বিখ্যাত শহর তাবরানে কবি ফেরদৌসী তূসীর মৃত্যুর এক শ' বছর পর ৪৫০ হিজরী ১০৫৮ খৃস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ
করেন। তাঁর নাম রাখা হয়,মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ। উপনাম আবু হামীদ। কিন্তু সমগ্র দুনিয়া তাকে গাযালী বলে ডাকে। এর পেছনে দু'টি কারণ বের করা হয়__”গাযলুন” আরবী শব্দ; অর্থ __সুতা কাটা বা সুতা পাকানো।
ইমাম সাহেবের পিতা মুহাম্মদ সুতা পাকিয়ে বিক্রয় করতেন। তাই পিতার পেশার নামানুসারে ঐখান্দানটা “গাযালী” (সুতা পাকানে ওয়ালা) নামে অভিহিত হয়। অপর কারণটি হলো__ গাযালা তূস জেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম।
ইমাম সাহেব ওখানকার অধিবাসী ছিলেন বলে তাকে “গাযালী” বলা হয়।
ইমাম গাযালীর শৈশব সুখের ছিল না। পারিবারিক অবস্থাও ছিলো না স্বচ্ছল।
শৈশবেই মাথার উপর থেকে। পিতৃছায়া হারিয়ে যায়।  দুর্ভাগ্যের নির্মম আচার। তিনি তখন একেবারে ছোট; পিতার মৃত্যু ঘটে। তৃত্যুকালে পিতা মুহাম্মদ ইমাম গাযালী ও তাঁর ছোট ভাই আহমদ গাযালীকে তাঁর এক বন্ধুর হাতে কিছু অর্থসহ তুলে দেন
এবং এ মর্মে অনুরোধ জানান __” আমার মুর্খতার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তপনি এদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবেন।” পিতা মুহাম্মদ কারণবশত শিক্ষার্জনের সুযোগ পাননি।
মৃত্যুর পর পিতৃবন্ধু কথামতো ইমাম সাহেবকে বিদ্যালয়ে পাঠান। কিন্তু কিছুকাল পর পিতা প্রদত্ত অর্থ ফুরিয়ে যায়। ঐ বন্ধু নিজেও ছিলেন নিঃস্ব। তাই তিনি শিক্ষার ব্যয় বহনে অপারগতা প্রকাশ করেনএবং ভাইদ্বয়কে তাঁদের সুবিধা মতো কোন এক মা
ভর্তি হওয়ার নির্দেশ দেন। এরই মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ইমাম সাহেবের উপর অন্যের তত্ত্বাবদানির।

বিদ্যার পথে অনিবারিত তৃষ্ণা:

দুই ব্যক্তির তৃষ্ণা কখনো নিবারণ হয় না; (এক) মালের প্রতি তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি। (দুই) বিদ্যান্বেষনকারীর তৃষ্ণা। বিদ্যানুরাগী বিদ্যান্বেষণেই শান্তি খুঁজে বেড়ায়। ইমাম গাযালী ছিলেন শিশুকাল থেকে জ্ঞানানুরাগী।
মনের ভেতর তাঁর ছিলো বিদ্যার প্রতি গভীর ভালোবাসা। তাই পিতৃবন্ধু তাকে ত্যাগ করলেও তিনি বিদ্যার্জন ত্যাগ করতে পারেননি।
তূস নগরের বিশিষ্ট আলেম আহমদ রাযকানীর নিকট অধয়ন শুরু করেন।সেখানে ফিকহ শাস্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।

জুরজান গমন:

প্রাথমিক শিক্ষার্জনের পর বিদ্যার্জনের তৃষ্ণা তাঁকে জুর্জান যেতে উৎসাহিত করে। ফলে তিনি জুর্জান গিয়ে আবু নসর ইসমাঈলীর নিকট শাফেঈ মাযহাব ও আশআরী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতি-নীতি অনুসারে বিদ্যার্জনের মাধ্যমে প্রাথমিক
বিদ্যার্জন সমাপ্ত করেন। জুর্জানের শিক্ষক আবুনসর তাকে যা শিক্ষা দিয়ে ছিলেন তার সবটুকু তিনি লিখে নোট করে রেখে ছিলেন। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ হেতু সেখানে তিনি উস্তাদের স্বতন্ত্র দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।

শিক্ষার্জন এবং চেতনার নতুন ধাপঃ

জুর্জানের শিক্ষা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন ইমাম গাযালী। বিভিন্ন আসবাবপত্রের সাথে বিশেষ যত্নসহকারে সঙ্গে ছিলো উস্তাদ থেকে অর্জিত বিদ্যার লিখিত নোটটিও। পথিমধ্যে একদল ডাকাতের সম্মুখী হন।
তাঁর সবকিছু লুন্টিত হয়। সেইসাথে লুন্টিত হয় নোটগুলিও। মালের সবকিছু হারিয়ে যাক এতে গাযালীর কোন দুঃখ নেই। কিন্তু নোটগুলি হারিয়ে যাওয়া ছিলো তাঁর বর্দাশতের বাইরে।
তাই তিনি খুঁজতে খুঁজতে উপস্তিত হলেন ডাকাত দলের সর্দারের কাছে। সর্দারকে কাতরকণ্ঠে বল্লেন __” আমি আমার হারানো মালের মধ্যে কেবল ঐ নোটগুলেই ফলরত পেতে চাই। কারণ, আমার জুর্জান সফর একমাত্র ঐগুলি অর্জনের জন্যেই।”
ডাকাতসর্দার হাসিতে ফেটে পড়লো; অতঃপর বললো__”শুধু ঐ নোটগুলি নেই বলেই তুমি অন্ধ হয়ে গেছো। তাহলে জুর্জানে তুমি কোন কচু শিখলে!” এই বলে নোটগুলো ফেরত দিলো।
সর্দারের এমন তিরস্কার গাযালীর হৃদয়ে তীরের মতো আঘাত করলো। নোটগুলু বাড়ি নিয়ে এবার তিনি মুখস্ত করতে বসলেন। ৩ বছরের সকল বিদ্যা তিনি কিছুদিনের মধ্যেই মুখস্ত করে ফেললেন।
মৌলিক শিক্ষার্জনের পর ইমাম সাহেব তূস থেকে নিশাপুর গমন করেন। সেখানে নিযামিয়া নিশাপুরের প্রধান শিক্ষক ইমামুল হারামাইন আব্দুল মালেক যিয়াউদ্দীন জুওয়াইনীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
নিযামিয়া নিশাপুর তথা মাদরাসায়ে বায়হাকিয়াহ ছিলো মুসলিম বিশ্বের সর্ব প্রথম মাদরাসা। এখানে তিনি ফিক্বহ, হাদীস, ইলমে কালাম, দর্শন ও অধিবিদ্যা শিক্ষা করলন।
ঐ সময় ইমামুল হরামাইনের শিক্ষার আসরে চার শ' ছাত্র শিক্ষারত ছিলেন। তন্মধ্যে সর্বাধিক মেধাবি তিনজনের মধ্যে ইমাম গাযালী ছিলেন অগ্রগন্য। ইমামুল হারামাইন বলতেন,__মর্যাদার দিক থেকে তাঁর শিষ্য গাযালী তাঁকেও ছাড়িয়ে গেছে।
নিশাপুরের মাদরাসায় ইমাম সাহেব ছিলেন একাধারে ছাত্র ও শিক্ষক। সেই যুগের নিয়ম ছিলো, শিক্ষকের শিক্ষাদানের পর ক্লাসের সর্বাপেক্ষা সেরা ছাত্রটি উস্তাদের শেখানো বিষয়টির পনরাবৃত্তি করতো।
ঐ নিয়মানুযায়ী ইমাম সাহেব উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ক্লাসের সবাই বিষয়টি আবার পড়িয়ে দিতেন। অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও দক্ষতাবলে ইমাম গাযালী অল্প দিনেই ইমামুল হারামাইনের চোখে স্বতন্ত্র স্থান দখল করে নেন এবং সমকালীন উলামাদের
মাঝে খ্যাতি অর্জন করেন। নিযামিয়া নিশাপুর মাদরাসায় থাকতেই ২০ বৎসর বয়সে তিনি শিক্ষার্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণামূলক লেখনীও তৈরী করতে শুরু করেন। এতে তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবুও তিনি উস্তাদ থেকে অ
ইলম লাভের আশায় ইমামুল হরামাইনের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেননি। ৪৭৮ হিঃ/ ১০৮৫ খৃস্টাব্দে ইমামুল হারামাইনের মৃত্যু ঘটলে ইমাম গাযালী ২৮ বছর বয়সে নিশাপুর ত্যাগ করেন।
মুসলিম বিশ্বে তখন ইমাম গাযালীর সমকক্ষ জ্ঞানী আর কেউ ছিলো না। নিশাপুর থাকা কালেই ইমাম সাহেব বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন।
যমানার শ্রেষ্ঠ এ জ্ঞানী যুগের প্রচলিত বিদ্যা শিক্ষাদানের জন্য তাঁর নিজস্ব একটা আসরও গড়ে তুলে ছিলেন।

উন্নতির চরম শিখড়ে ইমাম গাযালীঃ

জ্ঞানের পরি পূর্ণতায় যখন ইমাম গাযালী পৌঁছে গেলেন এদিকে আপন উস্তাদ ইমামুল হারামাইনকে ও হারিয়ে বসলেন এবার তিনি আর নিশাপুরে থাকতে চান না। তাঁর খেয়াল ব্যাপক ভাবে ইসলামের খিদমাত করে যাবেন।
ধর্মের শত্রু আর কুসংস্কারের গুড়ায় আঘাত হানবেন শক্তভাবে। কিন্তু এত বড় কাজ করতে তার একটি উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। ঠিক করলেন, সেলজুকী শাসক মালেক শাহের প্রধান উজির “নিযামুল মুলক হাসান বিন আলী”র
দরবারে উপস্থিত হবেন। নিযামুল-মুলক ছিলেন সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ইমাম মুওয়াফীকের ছাত্র। প্রধান উজির হওয়ার পাশাপাশি নিযামুল-মুলক ছিলেন জ্ঞান ও গুণের আধার। তাই তিনিও জ্ঞানী-গুনীদেরকে যথোপযুক্ত কদর করতেন।
তাঁর দারীর উপর বিশ্বাস রেখে সেলজুকি সুলতান মালেক শাহ রাজ্যের সমস্ত কাজ-কারবার তাঁর হাতে ন্যাস্ত করেন। নিযামুল-মুলকের সে মাহাত্যের ক
জেনেই ইমাম গাযালী নিযামুল-মুলকের বাসস্থল মা'আসকার অভিমুখে ১০৯০ খ্রীস্টাব্দে রওয়ানা হন। নিযামুল-মুলক ইমাম সাহেবের জ্ঞান-গভীরতা ও তাঁর সুদূর বিস্তৃত খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
তিনি ইমাম সাহেবকে সসম্মান ও সাদরে গ্রহণ করেন। সে যুগের জ্ঞানের শ্রেষ্টত্ব প্রকাশের উপায় ছিলো বিতর্ক সভায় বিজয় লাভ করা। ঐ যুগে বিতর্ক একটি বিশেষ অনুষ্টানে পরিণত হয়।
ইমাম গাযালী যখন নিযামুল-মুলকের দরবারে ছিলেন, তখন সেখানে শত শত আলিমের সমাগম হতো। নিযামুল-মুলক বিতর্ক সভার আয়োজন করতেন ; বিভিন্ন বিষয়ের উপর বাহাস অনুষ্ঠিত হতো।
প্রত্যেক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ইমাম গযালী বিজয় লাভ করতেন। ফলে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইমাম সাহেবের যুগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে নিযামুল-মুলক তাঁকে বাগদাদের নিযামিয়া মাদরাসায় প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত করেন।
ইমাম সাহেবের বয়স তখন ৩৪ বৎসর। ঐ নিয়োগ ছিলো ইমাম সাহেবের গৌরবের বিষয়। কারণ, সে সময় মুসলিম বিশ্বে ওটাই ছিলো সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়, যাতে প্রচলিত সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চ শিক্ষাদানের উত্তম ব্যবস্থা। জুমাদাল ঊলা
৪৮৪হি/জুন ১০৯১খ্রীস্টাব্দে ইমাম গাযালী প্রভাব-প্রতিপত্তির সাথে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং নিযামিয়া বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককের পদ অলঙ্কৃত করেন।
অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর বিদ্যা-বুদ্ধির প্রভাব প্রতিফলিত হয় এবং তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমমর্যাদা লাভ করেন। তাঁর প্রভাবে উজির ও আমীরদের মর্যাদাও ক্ষীণ হয়ে পড়ে।
তাঁর সাহাচার্য ও পরামর্শ ছাড়া রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সুরাহা করা হতো না। ঐ সময়ে মুসলিম শৌর্য-বির্যের দুটি কেন্দ্র ছিলো__সেলজুকী শাসন কেন্দ্র ও আব্বাসীয় শাসনকেন্দ্র। উভয় কেন্দ্রে ইমাম গাযালী প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন।
এক পত্রে গাযালী বলেন __ ” শহীদ সুলতান মালেক শাহ সেলজুকী ২০ বছর দেশ শাসন করেন। তাঁর হাতে ইস্পাহান ও গাগদাদের অনেক উন্নতি সাধিত হয়।
কয়েকবার আমি বড় বড় বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য সেলজুকী সুলতান ও আব্বাসী আমীরুল মুমিনীনের মধ্যে রাজদূতের ভূমিকা পালন করেছি। বাগদাদে থেকে ইমাম সাহেব খলীফা মুসতাযহির বিল্লার নির্দেশে ৪৮৫হিঃ/ ১০৯২খ্রীস্টাব্দে বাতিনিয়া
সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি বই রচনা করেন যা খলীফার নামানুসারে “আলমুসতাযহিরী” নামে অভিহিত করেন। গাযালীর আত্তজীবনী ” আল-মুনকিয মিনাদ-দালাল” গ্রন্থে ঘটনাটির উল্লেখ আছে।
বাগদাদের শিক্ষকতাকালে ইমাম গাযালীর শিক্ষার আসরে তিন শ' ছাত্র-শিক্ষক যোগদান করতেন। ঐ আসরে পাঠদান ছাড়া তিনি ওয়াজ-ও করতেন।  তাঁর ওয়াজগুলো ছিলো জ্ঞানমূলক।
ঐ ওয়াজগুলোকে ইবনুল লুবাব লিপিবদ্ধ করতেন। তিনি গাযালীর ১৮৩ টি  ওয়াজ লিপিবদ্ধ করেন, যা দু'খন্ডে সংকলিত হয়। এই সংকলনটি “মাজালিস-ই-গাযালীয়া” নামে অভিহিত হয় এবং তা বেশ খ্যাতি লাভ করে।

সত্যসন্ধানের সাধনাচূড়া ও ইমাম গাযালীঃ

১০৯১-১০৯৫ সাল পর্যন্ত মোট চার বছর শিক্ষাদানের পর ইমাম গাযালীর মানসিক অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যায়। শরীয়তের যে জ্ঞান তিনি শিক্ষা করে ছিলেন তার উপর দীর্ঘ চর্চার পর সে জ্ঞান আজ তাঁকে অপর এক পথের সন্ধান দিচ্ছে।
তাঁর ভেতরাত্তা বলছে__” জ্ঞানমূলক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক যত কাজই তুমি করছো সবই যেন পার্থিব উদ্দেশ্যপ্রসূত। একনিষ্ঠ ভাবে কেবলই সত্য সন্ধানে তো তুমি কিছুই করনি।” আত্তার এ আওয়াজ গাযালীকে পেরেশান করে তুললো।
কোন কাজে মন বসতে চায় না। শিক্ষকতায়ও না। চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন প্রায়ই। দেখায় অনেক সময়। কোন দাওয়াই কাজ করছে না। মন শুধু চাচ্ছে সত্যের নিষ্ঠ সন্ধান।
তিনি অনুভব করলেন, একমাত্র সত্য সন্ধানই আমার এ বিমারের দাওয়াই। তিনি ভাবলেন __ সংসার, সমাজসহ সকল বন্ধন ত্যাগ করে মুক্ত হয়ে ফিরবেন কেবলই সত্যের সন্ধানে।
এ ফিকির তাঁর মাথায় এসেছিলো ৪৮৮ হিঃ/ ১০৯৫ খ্রীস্টাব্দের রজব মাসে। কিন্তু ছ মাস পর্যন্ত তিনি বাগদাদ ত্যাগ করতে ঝতস্তত করলেন। শেষপর্যন্ত সফরের সংকল্প করলেন। বেরিয়ে পড়লেন বাগদাদ ছেড়ে সিরিয়ার পথে।
সিরিয়ার মরু অঞ্চলে তিনি হাঁটেন অবিরত। তখন এ মহা সাধকের অবস্থা ছিলো এমন__ তাঁর গায়ে চড়লো একখানা কম্বল। ক্ষুধার অন্ন হলো সাক-সবজি।
স্পেনের অধিবাসী আল্লামা আবুবকর ইবনুল আরাবী সিরিয়ার মরু অঞ্চলে গাযালীর বিচরণ স্বচক্ষে দেখেছেন। “যা-দুসসা-লেকীন” গ্রন্থে সে বিবরণ তিনি তুলে ধরেন__” আমি ইমাম গাযালীকে সিরিয়ার মরুপ্রান্তরে দেখেছি।
তাঁর হাতে ছিলো একটি পুরনো লাঠি। দেহে জোড়াতালি দেওয়া একটি ছেঁড়া জামা। আর মাথায় ছিলো পাগড়ী। অথচ এই লোকটিকে আমি বাগদাদে দেখেছিলাম উলামা বেষ্টিত।
চার শত আলেম নতজানু হয়ে তাঁর শিক্ষা আসরে উপবিষ্ট থাকতেন। তাদের প্রত্যেকের মাথায় থাকতো পাগড়ী। প্রত্যেকেই প্রখ্যাত ব্যক্তি বলে পরিগণিত ছিলেন। ইমাম সাহেবকে সিরিয়ার মরু প্রান্তরে দেখে তাঁর কাছে গেলাম এবং সালাম করলাম।

অতঃপর বিনয়সহকারে বল্লাম__” বাগদাদের শিক্ষার আসর আপনার জন্য কি এর চাইতে ভালো ছিলো না!” আমার কথা শুনে ইমাম সাহেব তীক্ষ্ন ও ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে  আমার দিকে

তাকালেন এবং বল্লেন __ “সৌভাগ্যের চতুর্দশ রাতের চাঁদ আল্লাহর সান্নিধ্যের আকাশে উদিত হয়েছে

এবং মিলনের সূর্য দিগন্তের পরিমন্ডলে অস্তমিত হওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়েছে। ” এর পর ইমাম সাহেব আমার প্রতি অবজ্ঞাভরে দেখলেন এবং

এই তিনটি শ্লোক পাঠ করলেন__
(১)”তারাকতু হাওয়া লায়লা ওয়া সা'দী বি-মানযিলি
ওয়া উদতু ইলা মাসহুবি আউওয়ালি মানযিলি।”

অনুবাদঃ

লায়লা ও সাদীর ভালোবাসা আমি ত্যাগ করে নির্জনতা অবলম্বন করেছি এবং প্রথম মানযিলের (মৃত্যুর) প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিয়েছি।

(২) “ওয়া না-দাত বিয়াল আশওয়াকু মাহলান ফাহাযিহী
মানা-যিলু মান তাহওয়া রুওয়াইদাকা ফাআনযিলি।”

অনুবাদঃ

অতঃপর ভালোবাসার প্রেরণা আমাকে এই বলে ডাকতে শুরু করলো __একটু থাম! তুমি যাকে চাও এটা সেই পথেরই মানযিল। তুমি একটু থাম এবং নেমে পড়ো।

(৩) “গাযালতু লাহুম গাযালান দাকীকান ফালাম আজিদ
লিগাযলী নাসাজান ফাকাসারতুহু”

অনুবাদঃ

আমি তাদের জন্য এমন সূতা কাটছিলাম, যা ছিলো মিহিন ও সূক্ষ। কিন্তু কাপড় বুনার কোন লোক না দেখে আমি আমার চরকা ভেঙ্গে দিলাম।

মরু, গিরি পেরিয়ে ইমাম সাহেব সিরিয়ার সিরিয়ার বৃহত্তম নগরী ও রাজধানী দামেশকে গিয়ে পৌঁছলেন। দামিশক পৃথিবীর অন্যতম সুপ্রাচীন নগরী হিসেবে পরিচিত।

৩৬ ডিগ্রি ১৮`পূর্ব দ্রাঘিমা ও ৩৩ ডিগ্রি ৩০` উত্তর অক্ষাংশে অর্থাৎ বাগদাদ ও ফাস নগরী একই অক্ষাংশে সমুদ্র পৃষ্ঠ

হতে প্রায় ৭০০ মিটার উচ্চতায় জাবালে কাসিউন নামক এক পাহাড়ের পাদদেশে ও মরুভূমির প্রান্তদেশে এই নগরী অবস্থিত।

দামিশক নগরীতে পৌঁছে ইমাম সাহেব আধ্যাত্মিক অনুশীলনে মশগুল হন। রোজ তিনি উমুরী জামে মসজীদের পশ্চিম মিনারায় চড়ে নীচের দর্জাটি বন্ধ করে দিতেন

এবং সারাটা দিন মোরাকাবা ও আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকতেন। তিনি একাধারে দু'বছর দামেশকে কাটান।

যদিও বেশীরভাগ সময় তিনি মোরাকাবা ও মুজাহাদায় কাটিয়েছিলেন, কিন্তু জ্ঞান চর্চা ত্যাগ করেননি। উমুরী জামে মসজিদটি ছিলো যেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

এর পশ্চিজ কোণে যে কক্ষটি ছিলো, তাতে বসে ইমাম সাহেব সময় সময় শিক্ষা দান করতেন।

ইমামাম গাযালীর তাসাউফ সাধনার শায়েখ ছিলেন শায়েখ আবু আলী ফারমাদী। তিনি ৪৭৭ হিঃ/ ১০৮৪ খ্রীঃ তূস নগরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন।

ইমাম ছাত্রজীবনে অনূর্ধ ২৭ বছর বয়সে বাইআত হয়ে ছিলেন।

দামিশকের অবিরাম চিন্তাভাবনা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন ইমাম সাহেবের মনে সচ্ছতা এনে দেয়; অবগুণ্ঠন সরে যায়; সন্দেহ দূরীভূত হয়।

তিনি অন্তর আলোক দিয়ে সত্য উদঘাটনের পথ বেছে নিয়ে ছিলেন। মনের শান্তানার জন্য তাসাউফের নীতি অবলম্বন করে ছিলেন।

স্বার্থকও হয়েছেন এ পথে। দু' বছর দামিশক অবস্থান করার পর ইমাম সাহেব বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে যাত্রা করেন।

আল্লামা যাহাবী লেখেন __” দামিশকে অবস্থানকালে একদা ইমাম সাহেব তথাকার আমীনিয়া মাদ্রাসায় গমন করেন। সেখানকার শিক্ষক ইমাম সাহেবকে চিনতে পারেননি।

ইমাম সাহেব তাঁর বক্তৃতায় বলছেন : ‘ইমাম গাযালী অমুখ অমুখ কথা লিখেছেন।' গাযালী কথাগুলো শুনলেন এবং

মনে করলেন, এতে তাঁর মনে হয় তো অহংকারের উদয় হতে পারে। তাই তিনি দামেশক ত্যাগ করে বায়তুল মুকাদ্দাস চলে গেলেন।

সেখানেও তিনি আধ্যাত্মিক সাধনা করতেন। তিনি বাইতুক মুকাদ্দাসে অবস্থিত সাখরার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিতেন এবং যথারীতি মুজাহাদা করতেন।

এরপর  ইমাম সাহেব ৪৯৯ হি / ১১০৫ খ্রীঃ মাকামে খলীলে যান সেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর কবর মোবারক

যিয়ারত করে সেখানেই তিনি ৩ টি প্রতিজ্ঞা করলন :

১/ কোন বাদশার দরবারে যাবেন না।
২/ কোন বাদশার উপহার গ্রহণ করবেন না।
৩/ কারো সঙ্গে বিতর্ক করবেন না।

আমৃত্যু ইমাম সাহেব এই প্রতিজ্ঞাগুলো পালন করেন। এর পর তিনি হজ্জে চলে যান। মক্কা শরীফ বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন।

মদীনা শরীফও যান। এই সফরে তিনি মিশর এবং আলেকজান্দ্রিয়ায়ও সফর করেন। আলেকজান্দ্রিয়ায় কিছুদিন অস্থানও করেন।

ইবনে খাল্লিকান বলেন __”এখান থেকেই ইমাম সাহেব মরক্কোর বাদশাহ ইউসুফ বিন তাশফীনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য মরোক্ক যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঐ সময়

ইউসুফের মৃত্যু হওয়ায় তিনি ঐ ইচ্ছা ত্যাগ করেন।” ইবনুল আসীর লিখেছেন __” ঐ সফরে ইমাম সাহেব  ‘ইয়াহইয়াউল উলূম' নামক গ্রন্থটি রচনা করেন।

হাজার হাজার লোক দামেশকে এই গ্রন্থটি অধ্যয়ন করেন।  ৩৮ বছর বয়সে ইমাম সাহেব বাগদাদ থেকে বের হয়ে ছিলেন।

প্রায় ১১ বছর পর ৪৯৯/১১০৬ খ্রীস্টাব্দে মাতৃভূমি তাবরানে প্রত্যাবর্তন করেন। ইমাম সাহেব তাঁর ” আল-মুনকিয মিনাদদালাল”

গ্রন্থে লেখেন __”হজ্জ করার পর পারিবারের আকর্ষণ আমাকে দেশে পৌঁছে দেয়। অথচ দেশে প্রত্যাবর্তনের কোন ইচ্ছাই আমার ছিলো না।

” দীর্ঘ ১১ বছরের সফটের ফলাফল কি হয়েছিলো এব্যাপারে তিনি বলেন__ মুজাহাদা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন

আমার মনকে এতখানি পরিচ্ছন্ন করেছিলো যে,মনের সব আবরণ হটে যায় এবং সমস্থ সন্দেহ দূরীভূত হয়।

সফর শেষে:

সফর যখন শেষ হলো দেশে ফিরে ইমাম সাহেব নির্জনতা অবলম্বন করেন।

এ সময় তাঁর মনের অবস্থা কি ছিলো তা তিনি বলেন __” দেশে ফিরে নির্জনতা অবলম্বন করলাম। কিন্তু যুগের প্রয়োজন ও জীবিকার তাগিদ আমার মনের পরিচ্ছন্নতাকে

কলুষিত করে দিচ্ছিলো। তবুও মনের মাঝে সান্তনা খুঁজে পেতাম। ” কিন্তু নির্জন অবস্থায় বেশীদিন তিনি থাকতে পারলেন না।

দেখতে পেলেন, মানুষ ধর্ম-বিমুখ হতে চলেছে। দর্শন ও বুদ্ধিবাদের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করতে গিয়ে ধর্মবিশ্বাস হার মেনে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় তিনি মনস্থ করলেন, নির্জনতা থেকে তাঁর বেরিয়ে আসা উচিৎ। ঐ সময় মালেক শাহের পুত্র সুলতান সনজরের উজির ফখরুল মুলক (নিযামুল-মুলক এর পুত্র)

তাঁকে আবার শিক্ষকতায় আসতে অনুরোধ করেন। ইমাম সাহেব তার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি সূফী ও বন্ধু-বান্ধবের কাছে পরামর্শ চাইলেন।

সবাই তাকে নির্জনতা ত্যাগের পরামর্শ দেন।
৪৯৯ হিঃ/১১০৬ খ্রীঃ ইমাম সাহেব নিশাপুরের নিযামিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা আরম্ভ করেন।

তথায় তিনি একবছর যথারীতি শিক্ষাদান ও ওয়াজ-নসিহতে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু ৫০০হিঃ/১১০৬খ্রীঃ ফখরুল মুলক এক বাতেনী অততায়ীর হাতে শহীদ হন।

এতে ইমাম সাহেব দারুণভাবে মর্মাহত হন। শিক্ষকতা ত্যাগ করে তুসে আবার নির্জনতা অবলম্বন করেন। জীবনের এ নিরবতায়ও হায়াতের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বাড়ির পার্শে

একটি মাদরাসা ও একটি খানকা স্থাপন করেন; যেখানে তিনি আমৃত্যু বাছা বাছা শিক্ষকদের বিশেষ ধরণের শিক্ষা ও

প্রশিক্ষণ দিতেন, জাহেরী ও বাতেনী উভয় প্রকারের জ্ঞান দান করতেন।

গাযালীর রচনাবলীঃ

ইমাম গাযালী ৫৪-৫৫বছর বেঁছেছিলেন। তিনি যখন থেকে লেখা-লেখি শুরু করেন তখনও তাঁর বয়স ২০ বছর হয়নি। এ

সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতর শিক্ষা-দিক্ষাদান, সহর-বন্দর ওমরু-প্রান্তর ভ্রমণসহ বিভিন্ন বেস্ততার পরেও তিনি লিখে গেছেন শতাধিক গ্রন্থ।

এসবের মধ্যে কোন কোনটি কয়েক খণ্ড বিশিষ্ট। ইমাম নববী (র.) তাঁর “বুস্তান” গ্রন্থে বলেন__”আমি ইমাম গাযালীর রচনা

ও তাঁর বয়স হিসাব করে দেখলাম যে, তিনি গড়ে দৈনিক  ১৬ পৃষ্টা করে লিখতেন।

ইমাম গাযালীর ওফাতঃ

ইমাম গাযালীর ওফাত এক আশ্চর্যজনক। পুরোটা জীবন যার খুদার সাধনায় উৎসর্গছিলো তাঁর মৃত্যু এরূপ হওয়াই স্বাভাবিক।

ইমাম জাওযী ইমাম গাযালীর ছুট ভাই আহমাদ গাযালীর বরাত দিয়ে বলেন__” সোমবার ইমাম সাহেব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেন ; ওযু করে নামায পড়েন।

অতঃপর কাফন আনিয়ে নেন এবং তা চোখের উপর বুলিয়ে বলেনঃ ‘ প্রভুর আদেশ শিরোধার্য ‘ এই বলে তিনি পা মেলে শুয়ে পড়েন।

সকলে দেখলেন, তাঁর প্রাণবায়ু উড়ে গেছে।” ৫৫ বছর বয়সে ৫০৫ হিঃ ১৪ জুমাদাল উখরা ১১১১ খ্রীঃ ১৮ই ডিসেম্বর

রোসোমবার এ মহা সাধক তাবরানের জমিতে ইন্তিকাল করেন।

সন্তানাদিঃ

ইমাম সাহেবের কয়েকজন কন্যাসন্তান ছাড়া কোন পুত্র সন্তান ছিলো না।

About Muhammad abdal

আমি মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আবদাল।দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেছি ২০২১ ইংরেজি সনে । লেখালেখি পছন্দ করি।তাই সময় পেলেই লেখতে বসি। নিজে যা জানি তা অন্যকে জানাতে পছন্দ করি,তাই মুসলিমবিডি ওয়েব সাইটে লেখা প্রকাশ করি। ফেসবুকে ফলো করুন👉 MD ABDALツ

Check Also

অধিক হারে ইস্তেগফারের ফজিলত

ইস্তেগফারের ফজিলত

হামদ ও সালাতের পর… রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যত ভালো কাজ শিক্ষা দিয়েছেন, তাতে …

Powered by

Hosted By ShareWebHost