কলব মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুস্থ কলব মানুষকে কল্যাণের পথদেখায়। আর অসুস্থ কলব মানুষকে কুপথে নিয়ে যায়।
আমাদের সমাজে অনেক মানুষ এমন রয়েছে, যাদের অন্তর মৃতপ্রায়।
যতই সুন্দর করে তার সামনে মুক্তার মতো কথামালা বলা হোক না কেন, তার ভেতরে কোনো ধরনের পরিবর্তন হয় না,
সে পরিবর্তন হওয়ার অনুভবও করে না। এর কারণ হচ্ছে, তার অন্তর মরে গেছে। তার অন্তর ভীষণ অসুস্থ হয়ে আছে।
এই অসুস্থ অন্তরের কারণে সে কোনো ভালো জিনিস অনুধাবন করতে পারে না।
তাই প্রতিনিয়ত তার দ্বারা খারাপ কাজ বেড়েই চলে। নিম্নে আমরা এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব যেগুলোর কারণে অন্তর কঠোর হয়ে যায়, অসুস্থ হয়ে যায়।
১/আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন থাকা :
যে অন্তর আল্লাহকে স্মরণ করে না, আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন থাকে, সে অন্তর ধীরে ধীরে বক্র হতে থাকে, সংকীর্ণ হতে থাকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড়সংকটময়।
আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাব।’ (সুরা : ত্বহা,আয়াত : ১২৪)
২/গুনাহে লিপ্ত থাকা :
কোনো ব্যক্তি যদি সব সময়, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত থাকে, আল্লাহ তাআলা তার অন্তরকে কঠোর করে দেন।
তার অন্তর মরে যায়, ভালো জিনিস কল্পনা করতে পারে না। আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকেন।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বান্দা যখন একটি গুনাহ করে তখন তার অন্তরের মধ্যে একটি কালো চিহ্ন পড়ে।
অতঃপর যখন সে গুনাহর কাজ পরিহার করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাওবা করে তার অন্তর তখন পরিষ্কার ও দাগমুক্ত হয়ে যায়।
আরো জানুন👉আল্লাহ তাআলার ক্ষমা প্রাপ্তি ও গুনাহ মাফির দশটি মাধ্যম
সে আবার পাপ করলে তার অন্তরে দাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তার পুরো অন্তর এভাবে কালো দাগে ঢেকে যায়।
এটা সেই মরিচা আল্লাহ তাআলা যার বর্ণনা করেছেন যে, কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনে জং (মরিচা) ধরিয়েছে।
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৩৪)
৩/সীমা লঙ্ঘন করা :
ইসলাম মধ্যপন্থা অবলম্বন করার কথা বলে। আল্লাহ তাআলা সীমা লঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। যারা আল্লাহ তাআলার আদেশকৃত বিষয়ে সীমা লঙ্ঘন করে,
কিংবা নিষিদ্ধ বিষয়ে সীমা লঙ্ঘন করে, আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তর বক্র করে দেন। ইরশাদ হয়েছে,
‘অতঃপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণেই তো আমি তাদেরকে আমার রহমত থেকে বিতাড়িত করি ও তাদের অন্তর কঠিন করে দিই।
তারা কথা নিজ স্থান থেকে সরিয়ে দেয় এবং তাদের যে বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল তার এক বড় অংশ ভুলে যায়।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত: ১৩)
৪/অতিশয় দুনিয়া আসক্তি :
দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক আসক্ত হওয়া, অন্তর কঠোর হয়ে যাওয়ার কারণ।
উকবাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজ হাতের দ্বারা ইয়েমেনের দিকে ইশারা করে বললেন,ঈমান এদিকে।
দেখো কঠোরতা এবং অন্তরের কাঠিন্য ওই সব বেদুইনের মধ্যে যারা তাদের উট নিয়ে ব্যস্ত থাকে (সব সময় দুনিয়া নিয়ে থাকে)। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩০২)
৫/মানুষের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় মেশা :
অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক অন্যের সঙ্গে মেশা, খারাপ সঙ্গীর সঙ্গে মেশা, এটাও অন্তর কঠোর হওয়ার কারণ।
লোকালয়ে বেশি সম্পৃক্ততার কারণে আমাদের মাঝে গিবত-শিকায়াত অহেতুক কথা, সমালোচনা ইত্যাদি হতেই থাকে।
আর এসব আমাদের অন্তরে প্রভাব সৃষ্টি করে। এ জন্য মানুষের সঙ্গে মেশার প্রয়োজন হলে তাহলে মন্দকে এড়িয়ে চলা। (মুফসিদাতুল কলব)
৬/অলীক আকাঙ্ক্ষা :
মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু অহেতুক,
অলৌকিক আর অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ভাবা, চিন্তা করা, এটাও মানুষের অন্তরকে কঠোর করে দেয়।
কারণ অহেতুক চিন্তা এমন সমুদ্র, যার কোনো কূল-কিনারা নেই। সে মিথ্যার সাগরে সারাক্ষণ নৌকা চালিয়ে বেড়ায়।
হ্যাঁ, ভালো চিন্তা করা, কিংবা উঁচু আকাঙ্ক্ষা করা, তার জন্য বিশেষ প্রতিদান আছে এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) উৎসাহ প্রদান করেছেন। (মুফসিদাতুল কলব)
৭/অতিভোজন :
জীবনের তাগিদে মানুষকে প্রতিনিয়ত আহার করতে হয়।
কিন্তু অতিভোজন অপ্রয়োজনীয়। তা শুধু স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং অন্তরের মধ্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলে।
আর তা যদি হারাম কোনো খাদ্য হয়, তাহলেতো তার ক্ষতি দুনিয়া ও আখিরাতে।
আর হালাল খাদ্য হলেও পরিমিত আহার করা উচিত।
তা মানুষের অন্তরকে ধীরে ধীরে মৃত বানিয়ে ফেলে। কারণ অতিভোজন মানুষের প্রবৃত্তিকে শক্তিশালী করে, আরএর প্রভাবে অন্তর কঠিন হতে থাকে। (মুফসিদাতুল কলব)
আরো জানুন👉হালাল উপার্জন ও হালাল ভক্ষণ
৮/অধিক নিদ্রা :
শরীরকে সতেজ রাখতে, কর্ম-উদ্যমতা ফিরে পেতে মানুষকে প্রতিনিয়ত ঘুমাতে হয়।
তাই বলে যদি সারা দিন মানুষ ঘুমাতে থাকে, তাহলে এর ক্ষতিও অনেক বেশি।
এ জন্য অপ্রয়োজনীয় ঘুম থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। যখন-তখন ঘুমানো শরীরকে যেভাবে নষ্ট করে,
তেমনি কলবকেও নষ্ট করে দেয়। (মুফসিদাতুল কলব)
১০/ অধিক হাসা :
অধিক হাসি মানুষের অন্তরকে মৃত করে দেয়। কেননা অধিক হাসিতে অভ্যস্ত ব্যক্তি তার হাসি-
কৌতুকের আধিক্যের কারণে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস প্রাণশূন্য হয়ে যায়।
সে কারণে অধিক হাসা থেকে বারণ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা অধিক হাসবে না।
কারণ অধিক হাসি অন্তরের মৃত্যু ঘটায়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১৯৩)
১১/গান-বাজনা শোনা :
গানবাদ্য মানুষের অন্তরকে মৃতপ্রায় করে দেয়। কারণ,
নাচগান বা অন্যান্য নিরর্থক বেহুদা কাজকর্ম আর রং-তামাশা এসব আল্লাহর স্মরণ থেকে মানুষকে বিমুখ করে দেয়।
আরো জানুন👉ইসলামে গান-বাজনা শরয়ী বিধান
জিকির যেভাবে মানুষের অন্তরকে সজীব করে, বিপরীতে গানবাদ্য মানুষের অন্তরকে মেরে ফেলে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই গান-বাজনাঅন্তরে কপটতা সৃষ্টি করে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯২৭)