Breaking News

এক খন্ড জীবন

(২৪ডটকম) 

এক খন্ড  জীবন

এক খণ্ড জীবন

হাতিম আল-ফেরদৌ

……………………………..

 

দক্ষিণ থেকে এসে পশ্চিমে মোড় নিয়েছে মনু।

মোড় নেওয়া তীরে একটি কদম সবুজে সতেজ হয়ে আছে। ফুল ফোটেছে ডালে ডালে।

ফুলের সাথে দুলন খেলছে দক্ষিণা বাতাস।

প্রকৃতির মিলন মেলা এই গাছের তলায় ফরহান বসে আছে।

দূর দিগন্তে ওই নদীর জলে ছল ছল করছে তার চোখ।

বিশটি বছর পর আজ এখানে এসে স্মৃতির আয়নায় জেগে উঠেছে ফরহানের দূরন্ত শৈশব।

জামিল ছিলো তখন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নানান উদ্ভিদে ঘেরা মনুর সবুজ তীরে

শৈশবে জামিলের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো আজো যেনো তরতাজা হয়ে আছে।

এখনো এখানে সকান-সন্ধ্যা অবিরাম বয়ে যায় নদীর স্রোত।

রাত শেষে এখানে আজো বেজে ওঠে দের কলধ্বনি।

নদীর দুকুল এখনো মুখর কৃষক আর রাখালের পদচারণায়।

শৈশবেও এগুলো ছিলো। কিন্তু সেই থাকা আর এই থাকাতে কেমন যেনো একটা বে-মিল বে-মিল মনে হয়।

মিলের বৈচিত্রের কথা ফরহানের আস্তে আস্তে মনে পড়তে শুরু করেছে_এই কদম গাছটি তখন ছিলো আরো ছোট,

তখন তার এতগুলো শাখা-প্রশাখা ছিলো না।

নদীতে স্রোত আছে ঠিক কিন্তু নেই আগের মায়াময়তা।

রাখাল আর কৃষকের পদচারণা আছে ঠিক তবে অতীতের চেনা মুখগুলো আজ হারিয়ে গেছে।

আগের সবগুলো থেকেও যেনো থাকলো না।

সময়ের স্রোতে সব ভেসে গেছে। ভেসে গেছে ফরহনের হৃদয়ের আত্মীয় শৈশবের জামিলও।

তখন ছিলো ওরা আট-নয় বছর বয়সী।

গরীবের ের ছেলে জামিল, গরু ছড়াতে তাকে প্রতি দিনই আসতে হতো নদীর তীরে।

ফরহানের বাবা শিক্ষিত , টাকা-পয়সার অভাব নেই তাদের।

ফরহান গরু ছড়াবে তো দূরের কথা বাড়ির কোনো কাজেও তাকে হাত দিতে হয় না।

নদীর পার্শবর্তী গ্রাম শিমুলপুরে তাদের বাড়ি।

আম-কাঁঠালীতে স্কুল বন্ধে নদী পার ঘুরতে এসে জামিলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ফরহানের।

আগে থেকেই একে ওপরকে চিনতো ওরা কিন্তু বন্ধুত্বের বন্ধনটা তখন ছিলো না।

সেদিন ফরহান নদী পারের এই কদমতলাতেই জামিলের সাক্ষাৎ পেয়েছিলো।

জামিল আশপাশে গরু ছেড়ে দিয়ে আনমনে বসে মাটিতে কি যেনো আঁকছিলো।

জামিলকে দেখে ফরহান আস্তে আস্তে ধার ভিড়লো।

জিজ্ঞেস করলো, “এই যে জামিল, কি করছো এখানে?”

গাম্বীর্যে ভারী চেহারাখানি তুলে ফরহানের প্রতি তাকালো জামিল।

ফরহান দেখতে পেলো জামিলের দুটি চোখে এক অব্যক্ত মায়াময়তা বিরাজ করছে।

কারো সাথে মিশতে চায় না জামিল। লাজুকতা জামিলের বৈশিষ্ট্য।

অন্তর্মুখী মানুষরা এমনি হয়ে থাকে।

দূরে রাখাল ছেলেরা খেলা করছে, জামিল ওদের সাথে মিশে না।

না মিশলেও সে যে খেলা-ধুলা করে না এমন নয়।

সে খেলে তার কল্প মানুষের সাথে। কল্পনায় কল্পনায় হাসি,

কথা, খেলা-ধুলা সবই তার চলে। ফরহান জামিলের একান্ত জগতে অংশী হতে এসেছে।

অবশেষে অংশী হয়েও গেলো। ফরহানের সাথে অল্প কথাতেই জামিলে মনে বন্ধুত্ববুধ জেগে উঠলো।

আম-কাঁঠালীর বন্ধের পনেরটি দিন কাটলো স্বর্গীয় স্রোতে।

হাডুডু, গুল্লাচুট, বন্দী, নদীতে সাতারকাটা সহ আনন্দের অনেক খেলাই তাদের মধ্যে চলে ছিলো এতো দিন।

আজ শেষ দিন , তবে বার বার দেখা হবে একে অপরের সাথে বুকে তাদের এই আশা।

জামিল বললো_ “ফরহান, আগামী আম-কাঁঠালীর বন্ধ পর্যন্ত কিন্তু আমি অপেক্ষা করতে পারবো না তোমার,

যখনই সুযোগ হবে চলে এসো। ” ফরহান বললো_” তা তো অবশ্যই জামিল,

তোমাকে ছেড়ে যে আর আমার সময় কাটে না-রে”

এই বলে জামিলের গলায় জড়িয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে নিলো ফরহান।

 

তারপর! তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই

বাড়িতে থেকে ফরহানের লেখা-পড়া ভালো হচ্ছে না বলে ঢাকায় মামার বাসাতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তাকে।

কিছুদিন পর ফরহানের পরিবারও চলে যায় ঢাকায়।

ঢাকাতে পরিবারের সকলের চায় চাকরীর ব্যবস্থা হয়ে গেলে আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যায়গ্রামের কথা।

ফরহান কখনো ভুলতে পারে না নিজের গ্রাম।

মাঝেমধ্যে ে এসে জামিল ফরহানের সাথে খেলা জুড়ে দেয়।

একা বসে থাকলে যেনো জানলার ফাঁক, ফুলের টব, দেয়ালের আড়াল,

আলনার পেছন থেকে জামিল তার মায়াময় মুখখানি একটু বাড়িয়ে হাত ডাকে_”ফরহান, এসো। ”

পড়ালেখার ব্যস্ততায় বা সঙ্গী পাওয়ার অভাবে ফরহানের আর যাওয়া হয় না গ্রামের বাড়িতে।

এখন সে ২৮-২৯ বছর বয়সী এক শক্তিমান যুবক, এখন আর গ্রামে যেতে সাথে কারো প্রয়োজন নেই,

কেবল প্রয়োজন একটু অবসরতার।

একদিন সময় করে ফরহান গ্রামের দিকে রওয়ানা দিলো।

গ্রামে এসে দেখে, সবকিছু কেমন যেনো পাল্টে গেছে।

ঢাকা যাওয়ার বেলা বাবা বাড়ি বিক্রি করে গিয়ে ছিলেন, নতুন মালিক বাড়িটাকে অন্যরকম করে সাজিয়েছে।

সেই কৈশোরে বাড়ির প্রবেশ পথে বড়ো সখ করে ফরহান একটি শিমুল গাছ রূপন করেছিলো,

প্রতিদিন নিয়ম করে গাছটির যত্ন নিতো সে।

আজ গাছটি অনেক বড় হয়েছে, হলে কি হবে,

এখানে যে আজ ফরহানের কোনো অধিকার চলে না।

অতীতের স্মৃতি খুঁজতে খুঁজতে ফরহান নদীর তীরের কদম গাছটির তলায় এসে বসলো।

কৃষক রাখালদের অনেকেই পাশ দিয়ে গেলো কিন্তু এপর্যন্ত কেউ ফরহানকে চিনতে পারলো না।

ফরহান হয়তো দুএকজনকে চিনতে পেরে ছিলো,

তবুও কেনো যেনো অনাগ্রহে বসে থাকলো।

সামনে নদীর তীর জুড়ে সবুজ ফসলের মাঠ।

ওই দিকে চেয়ে চেয়ে জামিলের কথা ভাবছে ফরহান।

ভাবছে, হঠাৎ হয়তো জামিল এসে পেছন থেকে তার দুটি চোখ চেপে বলবে

_”বলো তো দেখি কে” তখনই আলতু দুখানি হাত টেনে সরিয়ে নিয়ে দেখা যাবে সেই মায়াময় মুখখানি।

 

ভাবনার আবচা অন্ধকারে ফরহান দেখছে কাধে কুদাল ফেলে কে যেনো আসছে।

এটা আসা যাওয়ার পথ, যেকেউ এদিক  দিয়ে আসতে পারে তাই ফরহানের এনিয়ে ভাবার কথা নয়।

লোকটি যখন কাছে চলে এলো ফরহান তখন একটু খেয়াল করে চেয়ে দেখলো,

লোকটিকে জামিলের মতো লাগছে। বিশ বছরে ফরহান দৈহিক ভাবে,

যে পরিমাণ পাল্টেছে জামিলও যে এভাবে পাল্টাতে পারে তা এপর্যন্ত একটি বারও ফরহান ভাবেনি।

কিন্তু এখন জামিলকে দেখে ফরহান ভাবলো,

এ হয়তো সেই জামিল সময়ের ব্যবধান যাকে রূপান্তরিত করে দিয়েছে।

সেদিনের জামিল আজ রাখাল থেকে কৃষক সেজেছে।

কতো পরিবর্তন আজ_ উজ্জ্বল চেহারাটা এখন রোদ্রদাহে মলীন হয়ে আছে।

অগোছালো খুচা খুচা দাড়ি আর গোঁফের আড়ালে মুখের মায়াময়তা হারিয়ে গেছে।

গোটা দেহজুড়ে লালিত্যের যে মাধুরী মেশানো ছিলো এখন যেনো তা রুক্ষতার ভিড়ে হারিয়ে গেছে।

তবু ফরহান জিজ্ঞেস করলো_” তুই জামিল না? ” জামিল জবাব দিলো_” হ্যাঁ আমি জামিল”

তারপর পাল্টা প্রশ্ন করলো_” তুই ফরহান না? ” ফরহানও হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে জামিলের দিকে উঠার ইচ্ছে করলো কিন্তু জামিল দ্বিতীয় কোনো কিছুর অপেক্ষা না করেই ফরহানকে উপেক্ষা করে পাশ কেটে চলে গেলো।

ফরহান জামিলকে চিনলো , জামিলও ফরহানকে চিনলো তবুও সেদিনের বন্ধনে আজ জড়াতে পারলো না ওরা। জামিল যদি ফরহানকে এড়িয়ে নাও যেতো তবুও হয়তো সেদিনের মহব্বত ফিরে আসতো না, কারণ ফরহান যে জামিলের খুঁজে এসেছে সে জামিল তো কিশোর বয়সী ছেলে।

হৃদয় জুড়ে আশাভঙ্গের ব্যথা। বুক উজাড় করে একটি হাফ ছাড়লো ফরহান, তারপর উদাস দুটি চক্ষু ঝুলিয়ে দিলো ওই সীমানায়, যেখান থেকে নদী বহে যায়।

About আবদুল্লাহ আফজাল

হাফিজ মাওঃ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আফজাল। ২০১২ সনে হিফজ সম্পন্ন করেন। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন২০১৬ সনে। দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন ২০২০ সনে। ঠিকানা: বালাগঞ্জ, সিলেট। মোবাইল নাম্বার: 9696521460 ইমেইল:hafijafjal601@gmail.com সকল আপডেট পেতে এবং ওয়েবসাইটে লিখা পাঠাতে ফেসবুক পেজ👉MD AFJALツ ফলো করুন।

Check Also

শিক্ষকের মর্যাদা ও কর্তব্য

শিক্ষকের মর্যাদা ও কর্তব্য

(মুসলিমবিডি২৪ডটকম) এ পৃথিবীতে শিক্ষকতার আসনটি সবচেয়ে বেশি মর্যাদাশীল। এর চেয়ে অধিকতর সম্মানজনক কোন পদ আছে …

Powered by

Hosted By ShareWebHost