মুসলিমবিডি২৪ডটকম
টেলিগ্রামের মাধ্যমে ইনকাম কি বৈধ?
টেলিগ্রামে ‘‘ইনকাম'' করার অনেকগুলো চ্যানেলের একটি হলো Hamster Kombat।
আর Hamster Kombat হলো একটি গেইম— যা একটি টেলিগ্রাম এর সাহায্যে খেলতে হয়।
অর্থাৎ এই গেমটি খেলার জন্য আপনার ফোনে টেলিগ্রাম থাকা জরুরি।
এই গেইম খেলার জন্য কোনো দক্ষতার প্রয়োজন নেই।
এখানে আপনাকে দৈনিক শুধু কিছু টাস্ক (যেমন অন্যকে রেফার করা,
এড দেখা, youtube subscribe, twitter এ follow) কমপ্লিট করতে হবে ও নির্দিষ্ট সময় পর পর ট্যাপ করতে হবে,
যার বিনিময়ে তারা আপনাকে কিছু পয়েন্টস দিবে যাকে তারা HMSTR কয়েন বলছে,
যার বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। আপনি এটি যত বেশি খেলবেন তত বেশি কয়েন পাবেন।
ইসলামী শরীয়াহ মতে—টেলিগ্রামে Hamster Kombat সহ ইনকাম করার যতগুলো চ্যানেল আছে এর বেশির ভাগই নাজায়েয।
নাজায়েয হওয়ার অনেকগুলো কারণ হলো
১. এসব ইনকাম হচ্ছে, শ্রমবিহীন পারিশ্রমিক গ্রহণ।
আর শরীয়তে الأجر بلا عمل তথা শ্রমবিহীন পারিশ্রমিক গ্রহণও বাতিল পন্থায় অন্যের সম্পদ ভোগ করার অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
وَ لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ.
‘তোমরা নিজেদের মাঝে একে-অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।' (সূরা বাকারা ১৮৮, সূরা নিসা ২৯)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন
أنه يأكله بغير عوض.
‘বিনিময়হীন উপার্জন হল বাতিল পন্থায় উপার্জন।' (আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৭২)
হযরত হাসান বসরী রহ.-সহ আরো অনেক তাফসিরবিদ এই আয়াতের একই ধরনের ব্যাখ্যা করেছেন। (দেখুন, রুহুল মাআনী ৫/১৫)
২. এতে শরীয়ত নিষিদ্ধ আল গারার এর মতো বড় বড় খারাবি বিদ্যমান রয়েছে।
লেনদেনে গারার হচ্ছে এমন বিষয়—যার পরিণাম অস্পষ্ট, অজ্ঞাত।
বিশিষ্ট হানাফী ফকীহ শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রহ. বলেন
الغرر مايكون مستور العاقبة.
‘যার পরিণাম অস্পষ্ট তাই গারার।' (মাবসূত ১২/১৯৪)
ইমাম ইবনুল আছীর জাযারী রহ. বলেন—
الغرر ما له ظاهر تؤثره و باطن تكرهه، فظاهره يغر المشتري و باطنه مجهول.
‘গারার হল, যে কারবারে একটি প্রকাশ্য রূপ রয়েছে, যা দ্বারা মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
কিন্তু এতে অভ্যন্তরীণ এমন ত্রুটি রয়েছে, যা জানলে মানুষ এ থেকে বিরত থাকবে।
ফলে এর প্রকাশ্য রূপ ক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে দেয় আর অভ্যন্তরীণ রূপ অজানা থেকে যায়।' (জামিউল উসূল ১/৪৩২)
গারার লেনদেন নিষিদ্ধতার ব্যাপারে নবী কারীম সা. থেকে বর্ণিত আছে,
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন
نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن بيع الغرر.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল লেনদেনে الغرر (গারার)-কে নিষেধ করেছেন।'
(সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫১৩, জামে তিরমিযী, হাদীস ১২৩০)
৩. হালাল ও হারাম হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্টতা। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
“নিশ্চয়ই হালাল ও হারাম স্পষ্ট।
আর এ দুটির মাঝে কিছু সন্দেহপূর্ণ বিষয় আছে, যা অনেক মানুষ জানে না।
সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকে, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করে।
আর যে ব্যক্তি সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলোতে জড়ায়, সে হারামে লিপ্ত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কায় থাকে।” (সহিহ বুখারি ২০৫১)
৪. এসব কয়েনের পিছনে কি আছে তা অজ্ঞাত। কোন জিনিষকে তা প্রতিনিধিত্ব করছে,
কোন সম্পদকে তা প্রতিনিধিত্ব করছে তা অজ্ঞাত থাকা।
এসব কয়েনের পিছনে যা আছে তা যদি হালাল না হয়।
বরং ফ্রড হয়, স্ক্যাম হয় অথবা প্রতারণার বিষয় হয়। কোনো গেইমিং ওয়েবসাইট হয়, যেটার ব্যাপারে জানা নেই যে,
সেই গেইমগুলোতে হালাল জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে কি না ইত্যাদি।
তাহলে সেসব কয়েন যেমন আমাদের জন্য ক্রয় করা বৈধ না।
তেমনি কেউ যদি এটা আমাদেরকে গিফট দেয়, উপহার হিসেবে দেয়, তাহলেও সেটা আমাদের জন্য বিক্রি করে উপার্জন করা বৈধ নয়।
যেমন কেউ আমাদের মদ গিফট করল, তবে সেটা বিক্রি করে আয় করতে পারবো না।
পাকিস্তানের বিখ্যাত ফতোয়া বোর্ড — জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া বিন্নুরি টাউন করাচীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ,
ক্রিপ্টোকারেন্সি, অনলাইন গেমস, টাস্ক কমপ্লিট করে অর্থ উপার্জন করা প্রসঙ্গে। নিম্নে প্রশ্ন ও তাদের প্রদত্ত উত্তর হুবহু তুলে ধরা হলো—
প্রশ্নঃ টেলিগ্রামে কাজ করে অর্থ উপার্জন করা করা কেমন?
কাজের পর সেই এমাউন্ট ক্রিপ্টোকারেন্সিতে দেয়। তারপর সেই এমাউন্ট যে কোনো অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা যায়।
তাতে কোন বিনিয়োগ করতে হবে না। এখানে গেইম খেলতে হবে বা টাস্ক কমপ্লিট করতে হবে।
যেমন টুইটার বা ফেসবুক অথবা ইনস্টাগ্রামে ফলো করার কারণে দেয়া হয়ে থাকে। এসব কাজ করে উপার্জন করা কি বৈধ?
উত্তরঃ জেনে রাখা ভালো যে, ক্রিপ্টোকারেন্সি ‘বিটকয়েন' শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক মুদ্রা।
এতে প্রকৃত মুদ্রার মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং শর্তাবলি মোটেই বিদ্যমান নেই।
তাই বর্তমান সময়ে ‘কয়েন' বা ‘ডিজিটাল কারেন্সি' ক্রয়-বিক্রয়ের নামে,
ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক মার্কেটে যে ব্যবসা চলছে তা হালাল ও বৈধ নয়।
এসব হচ্ছে নিছক ধোকা-প্রতারণা। তাতে বাস্তবে কোন আসল পদার্থ নেই এবং এগুলো কবজাও করা যায় না,
শুধুমাত্র অ্যাকাউন্টে কিছু সংখ্যক পয়েন্টের মতো আসে।
এগুলো ফরেক্স ট্রেডিং এর মতই এক প্রকার সুদ ও জুয়া।
এজন্য ‘বিটকয়েন' বা যেকোনো ‘ডিজিটাল কারেন্সি' এর
তথাকথিত ব্যবসায় সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করা এবং ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয হবে না।
তাছাড়া শরীয়তে যে কোনো ধরনের খেলা বৈধ হওয়ার জন্য, তাতে নিম্নোল্লিখিত শর্তাবলী বিদ্যমান থাকা আবশ্যক।
অন্যথায় সেই খেলাধুলা ‘লাহুওয়াল হাদিস' তথা অসার ক্রিয়াকর্মের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে নাজায়েয ও নিষিদ্ধ।
১. সেই খেলাধুলা মৌলিকভাবে বৈধ হতে হবে। তাতে নাজায়েয কোনো বিষয় থাকতে পারবে না।
২. ওই খেলায় দ্বীনি বা পার্থিব কোন উপকার থাকতে হবে। যেমন শরীর চর্চা ইত্যাদি।
শুধু আনন্দ-ফুর্তি বা সময় কাটানোর জন্য খেলা বৈধ হবে না।
৩. খেলাধুলায় শরীয়ত বহির্ভুত কোনো বিষয় বিদ্যমান থাকতে পারবে না।
যেমন জুয়া, গান-বাজনা অথবা মিউজিক্যাল সাউন্ড অথবা নগ্নতা ও অশ্লীলতার ছড়াছড়ি বা শরীয়তে নিষিদ্ধ কোনো বস্তুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি।
৪. খেলায় এমনভাবে লিপ্ত হওয়া যাবে না, যার দরুন শরয়ী ফরজ বিধান আদায়ে গাফলত বা অলসতা চলে আসে।
–—-মোটকথা—
বর্তমানে যে সকল অনলাইন গেইম আছে, সেখানে উপরোল্লেখিত খারাবি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যায়।
তাছাড়া এসব খেলায় লিপ্ত হওয়ার ফলে শরয়ী ফরজ-ওয়াজিব বিধান আদায়ে গাফলত বা অলসতা চলে আসে।
তাই শরীয়াহ মতে এগুলো খেলা এবং তার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা অবৈধ।
আর টাস্ক কমপ্লিট করে অথবা ফলো করে অর্থ উপার্জন করার বিধান হলো,
সাধারণত এই ধরনের কাজের উদ্দেশ্য হয় ভিডিও, অ্যাপ,
পণ্য বা পেইজ ইত্যাদির প্রচার করা যাতে ক্রেতা/দর্শকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি।
এবং অন্যদেরকে আকৃষ্ট করা যায়। যদিও সত্যিকার অর্থে এভাবে চুক্তি কারীরা ক্রেতা নয়।
কোম্পানি/অ্যাপের মালিকরা জাল বিজ্ঞাপন অথবা ফলো করানোর জন্য অর্থ প্রদান করে থাকে যার ভিত্তি হলো ধোকা-প্রতারণা।
এসব টাস্ক কমপ্লিট করার কাজে যদি কোনো প্রাণী বা নারীর ছবি থাকে, তাহলে তা আরো জঘন্য ও নিষিদ্ধ কাজ বলে বিবেচিত হবে।
তাই এই ধরনের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করা বা তা থেকে অর্থ উপার্জন করা জায়েয হবে না।
সুরা মায়েদা, আয়াত ৯০, মুসনাদে আহমদ ২/১২৪,ফাতাওয়ায়ে শামী ৬/৪০৩, রুহুল মাআনি ১১/৬৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৪ (সাঈদ প্রকাশন)
[বিন্নুরি ফাতাওয়া নং 144602102227]
তথ্যসূত্র:হানাফী ফিকহ-Hanafi Fiqh by Khairul Islam 27/09/2024