(মুসলিমবিডি২৪ডটকম)
بسم الله الرحمن الرحي
নজরুলকে কে না চিনি। নজরুলের লেখা গান , গজল আর কবিতা আমাদের মুখে মুখে আজো ব্যাপক হয়ে আছে।
সাহিত্যের মানে তিনি এতই উন্নীত হয়েছিলেন যে অবশেষে তিনিই হলেন বাঙ্গালী জাতির কবি। সাহিত্যের পেছনে তাঁর অসাধারণ ত্যাগ আর সাধনাই
মূলত এতদূর তাকে পৌঁছে দিয়ে ছিলো। বাড়ী-ঘর, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী সবই তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন জীবনে,
আর সেই বিয়োগবেদনাই রসদ হয়ে তার সাহিত্যজগতে করেছিলো শক্তি বৃদ্ধি। মাইকেল এইচ হার্ট ( Michael H.Hart )-র The 100 বইটি ,
যা হামিদুল ইসলাম কর্তৃক সম্পাদিত, সেই বই থেকে এবার কাজী নজরুল ইসলামের অসাধারণ সংগ্রাম আর সাধনার জীবন তুলে ধরব ।
যদিও মাইকেলের লেখাতে নজরুলের সাধনা আর পরিশ্রমের সবদিক চলে আসেনি তার পরও সংক্ষিপ্ততা ও গ্রহণযোগ্যতার খাতিরে মাইকেলের হাওয়ালা নিয়েছি।
বাঙালি জাতির কাছে কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাংলা তার হৃদয় পটে অঙ্কিত এক স্মৃতিচিহ্ন।
পারিবারিক সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে যিনি আজীবন বাংলা কাব্য ও সাহিত্য চর্চায় ব্রতী ছিলেন, যিনি ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী,
যিনি বাংলা কাব্য সাহিত্যে প্রচন্ড বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন,যিনি দেশের স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জালেম শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে
কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কারাগারে বন্দী হয়েছিলেন, যার কাব্য সাহিত্যে ইসলামী ও ঐতিহ্য বলিষ্ঠ ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে, যার কবিতা, হামদ, নাত, গজল ও
ইসলামী গান প্রায় প্রতিটি বাঙালি মুসলিমের হৃদয়কে করেছে জাগরিত, তিনি ছিলেন একাধারে শ্রমিক, সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী
এবং একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক তাঁর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। বাল্যকালে তাঁর নাম ছিলো দুখু মিয়া।
বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ই জৈষ্ঠ্য মোতাবেক ১৮৯৯ সালের ২৫শে মে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
কবি একাধিক ভাগ্যবান কবির ন্যায় সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম লাভ করেননি। চুরুলিয়ার কাজী বংশ এককালে খুবই সম্ভ্রান্ত ছিল বটে;
কিন্তু যে সময়ে কবি নজরুল ইসলাম শিশু হয়ে আবির্ভাব হন, সে সময় এ বংশটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নানা রকম বঞ্চনা ও শোষণে
শিকার হয়ে আভিজাত্যের পশ্চাৎপট থেকে স্খলিত হয়ে দৈন্যদশার একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পড়েছিলো।
অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অপমান এবং মর্মান্তিক দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে কবির বাল্য, কৈশোর প্রাক যৌবন কেটেছে।
পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। ‘কাজী' হচ্ছে তাঁদের বংশের উপাধি। পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের মোতাওয়াল্লী।
ফলে ছোটবেলা থেকেই কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামী চিন্তা ও ভাবধারার ভেতর দিয়ে বড় হন। বাল্যকালে তিনি বাড়ির কাছেস্থ মক্তবে শিক্ষাজীবন শুরু করেন।
মাত্র 10 বছর বয়সে তিনি সুমধুর কন্ঠে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে পারতেন। বাল্যকালেই পবিত্র কুরআনের অর্থ ও তার মর্মবাণী শিক্ষা লাভ করতে শুরু করেন।
এছাড়া তিনি বাংলা ও আরবি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি মক্তবে ফারসি ভাষাও শিখতে থাকেন। হঠাৎ করে তার পিতা মারা যান তিনি নিতান্তই ইয়াতিম হয়ে পড়েন।
সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটন ও দুঃখ-দুর্দশা। লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি সুখে
আছি অর্জন করেন। লেটো গানের দলে কোন অশ্লীল গান পরিবেশন হতো না বরং বিভিন্ন পালা গান, জারি গান, মুর্শিদি গান ইত্যাদি পরিবেশিত হতো।
অসামান্য প্রতিভার বলে তিনি লেটো দলের প্রধান নির্বাচিত হন।
লেটো গানের দল থেকেই তিনি বিভিন্ন বইপত্র পড়ে
সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান। এ সময় তিনি কয়েকটি কবিতা, ছড়া গান, পালা গান রচনা করে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন।
এরপর তিনি শিক্ষালাভের জন্য গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তির সহযোগিতায় রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন। শৈশব কাল থেকে তিনি ছিলেন একটু চঞ্চল প্রকৃতির।
স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম কানুন তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাই হঠাৎ করে একদিন স্কুল থেকে উধাও হন তিনি। কিন্তু কোথায় যাবেন, কি খাবেন,
কি করে চলবেন ইত্যাদি চিন্তা করে এবং আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে তিনি আসানসোলের এক রুটির দোকানে মাত্র পাঁচ টাকা মাসিক বেতনে চাকরি গ্রহণ করেন। রু
তৈরীর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন কবিতা,গান, গজল, পুঁথি ইত্যাদি রচনা করেন এবং বিভিন্ন বইপত্র পড়ে তার জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে লাগলেন।
তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এবং ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুর হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন।
এরপর তিনি পুনরায় রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন। 1971 সালের বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র।
যুদ্ধের কারণে তার আর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া হলো না। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং 49 নম্বর বাংগালী পল্টন রেজিমেন্টের হাবিলদার পদে প্রমোশন লাভ করেন।
সৈনিক জীবনে তাঁকে চলে যেতে হয় পাকিস্তানের করাচিতে। কিন্তু তাঁর কবিতা ও সাহিত্য চর্চা থেমে যায়নি।
করাচি সেনানিবাসে সহকর্মী একজন পাঞ্জাবী মৌলভী সাহেবের সাথে তার পরিচয় হয়। তাঁর কাছ থেকে তিনি ফারসি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন
এবং মহা কবি হাফিজ, শেখ সা'দী (রহঃ) প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত কবিদের রচনাবলী চর্চা করেন।
এরপর থেকেই তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, হামদ-নাত, গজল, সাহিত্য ইত্যাদির ব্যাপক রচনার তাগিদ অনুভব করেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের তেমন কোনো সুযোগ না পেলেও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি তাঁর কাব্য ও সাহিত্য চর্চা চালিয়েছিলেন।
যুদ্ধ থেমে গেলে হাজার 1919 সালের এপ্রিল মাসে পল্টন রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার পর তিনি ফিরে আসেন নিজ মাতৃভূমি চুরুলিয়া গ্রামে।
এরপর শুরু হয় তাঁর একনিষ্ঠ কাব্যচর্চা। তাঁর লেখা একাধারে ‘দৈনিক বসুমতী', ‘মুসলিম ভারত', ‘মাসিক প্রবাসী',
‘বিজলী', ‘ধুমকেতু' প্রভৃতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে।
নজরুলের কবিতা তদানীন্তন রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নিপীড়িত,
নির্যাতিত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষদের জাগরণের তিনি ছিলেন মহান প্রবক্তা।
1921 সালে মাত্র 22 বছর বয়সে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী' যা বাংলা সাহিত্যে তাঁকে ‘বিদ্রোহী' কবি হিসেবে অমর করে রেখেছে।
বল বীর বল
চির উন্নত মম শির
শির নেহারি নত শির ওই
শিখর হিমাদ্রির।
দেশ প্রেমিক কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে তাঁর কলমকে ভুলেট হিসেবে ব্যবহার শুরু করলেন।
ইতি মধ্যে সমগ্র দেশে শুরু হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী তুমুল আন্দোলন। কাজী নজরুল ইসলাম ‘সাপ্তাহিক ধুমকেতু' পত্রিকায় লিখতে লাগলেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে।
অন্যায়, অবিচার, অসাম্য ও অসত্যের বিরুদ্ধে তিনি লিখনির মাধ্যমে শুরু করলেন প্রচন্ড বিদ্রোহ।
তিনি মুসলিম জাতিকে তাদের অতীতের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে শুনিয়েছেন জাগরণের বাণী।
তিনি স্বদেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে।
1993 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে'র মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এদেশের বিশেষ করে মুসলমান কৃষকদের ক্রমান্বয়ে নিঃস্ব করে ফেলেছিল।
মুসলমান কৃষকরা তাদের জায়গা জমি ও বাড়িঘর সব কিছু হারিয়ে প্রায় পথে বসে ছিল। কবি কাজী নজরুল ইসলাম
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে এদেশের কৃষক সমাজকে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানান। তিনি ‘সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের কৃষাণের গান নামক কবিতায় লিখেছেন___
চল চল চল
ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল,
নিম্নে উতলা ধরণী-তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল।
চল চল চল
বর্তমানে বাংলাদেশসরকার এ কবিতাটিকে রণসংগীতের মর্যাদা দান করেছেন। পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত জাতির
জীবনে অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার নির্মূল করার ব্যাপারে তার আবেদন চির অম্লান।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহু হামদ, নাত, গজল, আধুনিক গান, ইসলামী গান, গল্প, কবিতা, সাহিত্য ও উপন্যাস রচনা করে যান।
এসকল বিষয়ে তাঁর রচনা রোহিঙ্গা সহস্ত্র। তাঁর রচনাবলির মধ্যে অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, দোলনচাঁপা, চক্রান্ত, প্রলয় শিখা, ভাঙ্গার গান, নতুন চাঁদ, ফনীমনসা, রিক্তের বেদন,
মৃত্যুক্ষুধা, সাম্যবাদী, সর্বহারা, সিন্ধু হিন্দোল, রাজবন্দীর জবানবন্দী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ‘নজরুল ইন্সটিটিউট' নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর লেখার ওপর
গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি ইন ফার্সি ভাষার মহাকবি হাফিজের কতগুলো কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের অধিকাংশ কবিতা ও সাহিত্য রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায়ও তার লেখার অনুবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে।
1945 সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবি জগত্তারিণী পুরস্কার প্রাপ্ত হন। অন 1960 সালে সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন।
1970 সালে বিশ্বভারতী কবিকে ‘ডিলিট' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। 1973 সালে কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ‘ডিলিট' উপাধি লাভ করেন।
হাজার 1975 সালে কবিকে ‘একুশে' পদক প্রদান করা হয়।
আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে মুসলিম সাধনার সবচেয়ে বড় প্রেরণা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
তারাবির ভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য কাব্যসাধনা দিগন্তে নবোদিত সূর্যের মহিমা বিচ্ছুরিত হয়েছে। ইসলামী বিভিন্ন বিষয় গুলোকে তিনিই প্রথমবার সত্যিকারের সাহিত্যে রূপ
দিয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও প্রবীনদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন, মহাকবি কায়কোবাদ, কবি গোলাম মোস্তফা, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
এবং নবীন দের মধ্যে কবি ফররুখ আহমেদ, সৈয়দ আলী আহসান, তালিম হোসেন, কাদের নেওয়াজ প্রমুখ কবিরা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধের বাণী উচ্চারণ করেছিলেন।
কিন্তু সেবানি নজরুল ইসলামের নেয়ায় বজ্রকন্ঠ ছিল না, ছিল অর্ধোচ্ছারিত। নজরুল কাব্যে ইসলামী ও মুসলিম ঐতিহ্য বলিষ্ঠ ব্যঞ্জনিয় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
নজরুল ছিলেন মুসলিম পুনর্জগরনের কবি এবং স্বাধীনতা চেতনার প্রতীক। বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার ইসলামী আদর্শ
এবং মুসলিম ঐতিহ্যের রূপায়ণে নজরুল ইসলামের অবদান অবিস্মরণীয়।
তিনি খেয়া পারের তরণী কবিতা লিখেছেন___
‘আবুবাকার, উসমান, উমর, আলী হায়দার,
দাঁড়ী যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর।
কান্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি-মাল্লা,
দাঁড়ী মুখে সারিগান __ লাশারীক আল্লাহ।'
কারবালার মর্মান্তিক বিয়োগান্ত ঘটনা কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি সুন্দর ভাবে তার কাব্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন__
‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া।
আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারের সোরাতে।'
ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম জাতির স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন__
‘ধর্মের পথে শহীদ যাহারা, আমরা সেই সে জাতি।
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বের করেছি জ্ঞাতি।
আমরা সেই সে জাতি।'
কাজী নজরুল ইসলামের আল্লাহর প্রতি ছিল অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস। মানুষের প্রতি আল্লাহ পাকের অশেষ নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করে তিনি লিখেছেন__
এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।
এই শস্যশ্যামল ফসল ভরা মাটির ডালিখানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।
তুমি কতই দিলে রতন, ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন
ক্ষুধা পেলে অন্ন জোগাও মানি চাইনা মানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।
তিনি ইসলামের মৌলিক ইবাদত ও বিধানকেও বাংলা কাব্যে যথাযথভাবে প্রয়োগ করেছেন।
তিনি লিখেছেন__
“মসজিদে ঐ শোনরে আজান চল নামাজে চল,
দুঃখে পাবি সান্ত্বনা তুই বক্ষে পাবি বল।
তুই হাজার কাজের ওসিলাতে নামাজ করিস কাজা,
খাজনা তারি দিলি না যে, দিন দুনিয়ার রাজা।
তারে পাঁচবার তুই করবি মনে, তাতেও এত ছল
ওরে চল, নামাজে চল।”
এমনইভাবে কবি নজরুল ইসলাম তার কাব্যে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর প্রতিটি ইসলামী গান,
গজল, হামদ ও নাত প্রায় প্রত্যেক বাঙালি মুসলমানের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল ও মিলাদ মাহফিলে তার লেখা হামদ, নাত
ও গজল পঠিত হচ্ছে।
1942 সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক দূরূহ ব্যধিতে আক্রান্ত হন এবং বাকশক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন।
তাকে সুস্থ করে তোলার জন্যে দেশের সকল প্রকার চিকিৎসা ব্যর্থ হবার পর হাজার 953 সালে সুচিকিৎসার জন্যে সরকারি ব্যবস্থাধীনে লন্ডনে পাঠানো হয়।
কিন্তু সেখানেও কবিকে রোগমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তারপর ১৯৭২ সালে তাঁকে বিদেশ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় নিয়ে আসা হয়
এবং ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর বাংলা ১৩৮৩ সালের ১২ই ভাদ্র মোতাবেক
১৯৭৬ ইং সালের ২৯শে আগস্ট এ বিখ্যাত মনীষী পিজি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি তাঁর একটি ইসলামী সংগীতে ওসিয়ত করে জানান,
তাকে মসজিদের পাশে কবর দেয়ার জন্যে; যেন তিনি কবরে শুয়েও মুয়াজ্জিনের সুমধুর আযানের ধ্বনি শুনতে পান। তিনি লিখেছেন __
“মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
…………………………………………………..
……………………………………………………
আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।
গোরআযাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।”
তাঁর সে অশিয়ত অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয়। মসজিদের পাশে কবি আজ চির নিদ্রায় শায়িত।
প্রতিদিন প্রায় অসংখ্য মানুষ নামাযান্তে কবির মাজার জিয়ারত করছে। আজ কবি পৃথিবীতে নেই; কিন্তু বাংলা কাব্যে কবি ইসলামী ভাবধারা ও মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ সৃষ্টিতে
যে অবদান রেখে গেছেন, প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের হৃদয়ে কবি অমর হয়ে থাকবেন।
কবি নজরুলের কথা মনে হলে বাঙালি জাতির মনে বিদ্রোহের ভাব জেগে ওঠে, গরম হয়ে ওঠে রক্ত।